বাংলাদেশের পাখি : ধুলাে চড়ুই

বাংলাদেশের পাখি : ধুলােচাটা
মাঠের এই পাখির অনেকগুলাে নাম : ধুলােচাটা, বালুচাটা, ধুলােচড়ুই । বাগেরহাটে মেঠোচড়ই। ইংরেজি নাম Ashy-Crowned Sparrow Lark. ইংরেজি নাম থেকেই বােঝা যায় দেখতে এরা চড়ুইয়ের মতাে বা ভরত পাখির মতাে। স্বভাবেও তাই। বৈজ্ঞানিক নাম Ereriopterix Grisea, শরীরের মাপ ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। মেয়ে-পাখিটা আকারে একটু ছােট।

জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝিমধরা দুপুরবেলায় চষাক্ষেতের ভেতর খেলায় মেতেছে দু’টি পাখি। ধুলােয় মাখামাখি শরীর। বড় বড় ঢিলের মাঝে ধুলােয় বসে ওরা ডানা ঝাপটে পরস্পরকে ধুলােস্নান করাচ্ছে। দুই পা দিয়ে ধুলাে আঁচড়াচ্ছে। ধুলােয় বুক-পেট মিশিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ধুলােয় আচ্ছন্ন পাখি ছ'টির শরীর। 'কিচ কিচ চাপাস্বরে কর্তাবার্তাও চালাচ্ছে সমানে। রােদ্দুরের গরম ধুলােয় স্নান করছে, একটাই উদ্দেশ্য—চামড়ার অতিক্ষুদ্র পরজীবী কীট তাড়ানাে। ধুলােকণা লেগে কাটগুলাের শ্বাসবন্ধ অবস্থা। ধুলােকণার ওপরে উঠলে পাখিটা দাড়িয়ে প্রচণ্ড শরীর ঝাকুনি দিলে ধুলােকণার সঙ্গে কীটগুলােও ছিটকে পড়ে।

বাংলাদেশের বহু পাখি, বিশেষত চড়ুইরা এভাবেই পরজীবী কটি তাড়ায় শরীর থেকে। এই ছ'টি পাখিও দেখতে যেমন চড়ুইয়ের মতাে, আকারেও তেমনি। ' আনুমানিক ৩০ মিটার দক্ষিণের শিমুলগাছ থেকে উড়ল একটি খােপাঈগল, আসছে এদিকেই। ওর ডানার ছায়া দেখে স্থির হয়ে গেল ধুলােয় বসা পাখি দু’টি। নজরে পড়লে ছোঁ মেরে বসলে ঘটে যাবে মহাবিপদ। ঈগলটি অবশ্য জানার ছায়া ঢেলে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল সােজা উত্তরদিকে। একটু বাদেই শিমুলের ফাটা ফল থেকে লাফিয়ে বেরুল ৫টি তুলােৰীজ। চমৎকার সাদা তুলাের বীজগুলাে যেন বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে নেমে আসছে মাঠের দিকে। কী যে হল এ সময় পাখিদের।

আনন্দের ডাক ছেড়ে উড়ল ঝট করে, এগিয়ে গিয়ে উড়ন্ত তুলােবীজ ঠোটে ধরতে চাইল। কিন্তু ওদের ডানার বাতাসে হােক কিংবা এমনি বাতাসেই হােক, তুলাে ফুলগুলাে ছিটকে ছিটকে সরে যেতে লাগল। পাখিগুলাে চেষ্টা তবু করেই যাচ্ছে। এ সময়ে এক ঝলক হাওয়া খেলে গেল শিমুলগাছটির মাথায়, আরাে ৭/৮টি তুলােবীজ খসে পড়ে বাতাসে ঘুরপাক খেতে খেতে আসছে পাখিগুলাের দিকে। ওরা এবার মরিয়া হয়ে ধরতে চাইছে তুলােফুল, কিন্তু ধরতে পারছে না। উড়ন্ত তুলােবীজা নিয়ে যেন পাখিগুলাে মেতেছে চোখজুড়ানাে-মনভরানাে এক আশ্চর্য খেলায়।

একটি ফুলও ধরতে পারল না শূন্যে। ধরল অনেকটা দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ার পর। তিনটি মেয়ে-পাখি ঠোটে তুলােফুল নিয়ে উড়ে এল আবার আগের ধুলােস্নানের জায়গায়। এই চষাক্ষেতটির ভেতরেই কিছুটা দূরে দূরে বাসা করছে ওরা। বাসার উপকরণ হিসেবেই তুলোর দরকার ওদের। পুরুষরা বাসার উপকরণ আনে না, বাসাও বাঁধে না। তবুও ওরা কেন যে মেয়েপাখিদের পাশে পাশে উড়ে তুলােবীজ ধরার কসরত করছিল!

পুরুষ ধুলােচাটার চোখ-কানের নিচের অংশ সাদা রঙে ভরা, বুকপেটের ওপরে ডানার নিচের অংশও সাদা। গলা-বুক-পেট ও লেজের তলার রঙ কুচকুচে কালো। চোখের পাশটা যেমন কালাে তেমনি চোখের ওপর দিয়ে কালাে একটা টান নেমে চলে গেছে ঘাড়ের দিকে, আবার আংটির মতাে পাক খেয়ে কালাে একটা টান এসে মিশেছে গলার কালাের সঙ্গে। মাথার চাঁদি ও পিঠের রঙ বালু ও ছাইরঙের মিশ্রণ, তাতে বাদামির আভা। ডানার ওপরে ও প্রান্তে পাটকিলে বাদামি ছােপ ও টান আছে।
মেয়ে-পাখির চাঁদি, পিঠ ও ডানার রঙ পুরুষটির মতােই। গলা-বুকপেট হালকা বাদামি। মেয়ে-পাখির শরীরে সাদা বা কালাের চিহ্নমাত্র নেই। চিবুক লালচে বাদামি। উভয়ের ঠোটের রঙ গােলাপি, তাতে অতি সামান্য নীলচের আভা। পা নীলচে-আভা মেশানাে পাটকিলে বাদামি। চোখের রঙ উজ্জ্বল পিঙ্গল।

শরৎ-হেমন্তে যখন উইপােকা বা ডানাওয়ালা পিঁপড়েরা দলবেঁধে মাটি থেকে আকাশে উড়তে থাকে তখন নানা ধরনের পােকাখেকো পাখির সঙ্গে মাঠের এই পাখির অনেকগুলাে নাম ধুলােচাটা, বালুচাটা, ধুলােচই। বাগেরহাটে মেঠোচড়ুই। ইংরেজি নাম Ashy-Crowned Sparrow Lark, বৈজ্ঞানিক নাম Eremiopterir grisea. শরীরের মাপ ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। মেয়ে-পাখিটা আকারে একটু ছােট।
সুযােগ পেলে ধুলােচাটারাও উইপােকা ধরে। আবার নাড়াবনে আগুন দিলে বা ধানক্ষেতে বা ধানের গােলায় আগুন লাগলে ধান পুড়ে খই ছিটকালে ছুটে আসে বহু পাখি খই খেতে। তাতে ধুলােচাটারাও বাদ পড়ে না। তবে ফিঙে, বুলবুল বা দোয়েলের মতাে দক্ষ নয় ওরা। এছাড়াও ধুলােচাটার খাদ্যতালিকায় আছে কচি ঘাসের ডগা ও বীজ, ধান, চাল, গম, কাউন, চিনাদানা, সর্ষে, কেঁচো ও ফড়িংসহ নানান রকম পােকামাকড়।

শীত ও বর্ষাকাল বাদে ধুলােচাটারা বছরের যে কোনাে ঋতুতে বাসা বাঁধতে পারে। বাসা বাঁধে খােলা মাঠে, গৰ্তমতন জায়গা পছন্দ। মাঠের ঝােপঝাড়, উলুঘাসের বন বা অন্যান্য মেঠোউদ্ভিদ এড়িয়েই বাসা করে। আমি বহুবার এদের বাসা দেখেছি, ডিম বাচ্চা দেখেছি। এরা যেমন ধুলােমাটির সাথে মিলেমিশে গা ঢাকা দিতে জানে তেমনি এদের বাসা-ডিমও খােলা মাঠে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে গরু-ছাগল বা মানুষের পায়ের তলায় ডিম-বাচ্চা নষ্ট হয় অনেক সময়। সাপ, বেজি, গুইসাপ, বনবিড়াল, খেকশিয়াল বা শিকারি পাখিদের কবলে পড়ে কখনাে কখনাে। বাসা বাঁধার সময় বালুচাটারা মাঠের পাখি নীলকণ্ঠ ও হষ্টিটির সাহায্য যাতে পাওয়া যায়।

সেদিকে খেয়াল রাখে । উল্লিখিত পাখি দুটি চেঁচামেচিতে যেমন পক্ষীকুলের ভেতর সেরা, তেমনি সাহস আর বুদ্ধিতেও বাড়া। দু'টি পাখিই শত্রুকে ডাইভ মেরে ভড়কে দিতে পারে। বাসা বাঁধার আগে পুরুষ বালুচাটা আনন্দে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সুন্দর গান গায়! ভরতের মতাে গান গাইতে গাইতে খাড়া উঠতে থাকে শূন্যে, ১০০-১৫০ ফুট পর্যন্ত ঝিরঝির করে ডানা ঝাকাতে ঝাকাতে, তারপর নেমে আসে সােজা। বড় চমৎকার দৃশ্য !

দু'জনে মিলে বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে লাগায় ২-৪ দিন। বাসা শেষ করতে সময় নেয় ৩-৫ দিন। বাসার মূল উপকরণ হচ্ছে গরুর লেজের চুল, মেঠো মাকড়সার জাল, সুতাের মতাে সরু ঘাস, পাটের আঁশ, অন্য পাখির ফুল-পালক, নরম উদ্ভিদের অংশ। ঠোট দিয়ে ঠেলে বা টেনে আনে শােলার টুকরাে, মরা শামুকের খােল, গাছের শুকনাে ডাল বা ঢিলের টুকরাে। এগুলাে বাসার পাশে রাখে দেয়ালের মতােবাসাটি আড়াল করার জন্য।

প্রায় সময়ে ডিম পাড়ে ২টি, কখনাে ৩টি। ডিমের রঙ সবুজ, তাতে হলদেটে আভা থাকে, সেই সঙ্গে সাদার মিশেল। ডিমে মেটে-ধূসর অসংখ্য ছিটছােপ থাকে। চড়ুইয়ের ডিমের আকারেরই ডিম, তবে গােল ভাবটা বেশি। আমি বেশ ক'বার চড়ই ও ভরতের ডিমের সাথে এদের ডিম বদলে দিয়েছি। তা দিয়েছে সবাই, কিন্তু বাচ্চা ফোটে নি।

বালুচাটারা পালা করে ডিমে তা দেয়। বাচ্চা ফোটে ১১-১৩ দিনে। উড়তে শেখে ওই ১১-১৩ দিনেই। তবে তার আগেই বাচ্চারা মা-বাবার পেছনে পেছনে হেঁটে বেড়ায়, বাবা-মার মুখ থেকে খাবার খায় । উড়তে শেখার মাসখানেক পরেই বাচ্চারা স্বাবলম্বী হয়ে যায়। বাচ্চারা ভীষণ দুই কিন্তু মা-বাবা বা অন্য কারাে হুশিয়ারি পেলেই সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বুক-পেট ঠেকিয়ে অনড় হয়ে যায়। হট্রিটিরা যেমন উড়ে উড়ে মাটিতে থাকা ছানাদের নানান রকম নির্দেশনা দেয়, তেমনি ধুলােচাটারাও বাচ্চার আশেপাশে শত্রু দেখলে উড়ে উড়ে নির্দেশনা দেয়, চালিত করে।

এ এক রহস্যময় ব্যাপার! বাবা-মা বলছে, চুপচাপ থাক, পশ্চিম দিকে বা উত্তর দিকে, যা ওড়ার ভঙ্গিতেও থাকে নির্দেশনা। বালুচাটা বাংলাদেশের সব এলাকাতেই আছে। ধুলােময় খােলামাঠ আর বালুময় নদীর ঘাট বা চর এদের প্রিয় জায়গা। ভালােই আছে। খাদ্যাভাব নেই, নেই বাসা বাঁধার জায়গার অভাব। মাঠের পাখি ভরত, পিপিট, হইিটি, রিং-প্লোভার, মেঠো-হাতারে, নীলকন্ঠ ও ধনটুনির সাথে আছে চমৎকার সমঝােতা। তবে কোয়েলকে (কোকিল নয়) তেমন পছন্দ করে না। মাঠে আসা চড়ুইদের পছন্দ করে খুব।

বাবুইদের আবার একেবারেই সহ্য করতে পারে না। হুপােপাখি মাঠে নামলে ধূলােচাটারা পিছু নেয়। হপাের ঠোটের খোঁচায় পােকামাকড় উড়লেই ধরে খায়। হুপােরা অবশ্য তাতে কিছু মনে করে না। অকালবর্ষণে বাসা নষ্ট হলে বড় কষ্ট পায়। শিলা পড়লে বাসায় বসে ডিম-বাচ্চা আগলে রাখে। বৃষ্টিতে ভেজার পরে বৃষ্টি কমলে এরা উড়ে উড়ে ডানা শুকায়, আবার রঙধনু উঠলে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গান গায় । “টিরি টিরি...রি...রি... ঝিকি...ছিটি ছিটি...।

বৃষ্টিস্নানও করে। কখনাে কখনাে মাটিতে পড়া শিলাও খায়। শীতের প্রচণ্ড কুয়াশার দিনে এরা চুপচাপ বসে থেকে দুঃখের গান গায় । বালুচাটা বা ধুলােচাটাদের খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় বটে, কিন্তু ঝাঁকিজাল দিয়ে এদের ধরা যায় না। জাল মাটিতে পড়ার আগেই ফুড়ুৎ। শীতে এদের রৌদ্রস্নানের দৃশ্য বড়ই চোখজুড়ানাে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url