বাংলাদেশের পাখি : মােচা টুনি

মােচাটুনির ইংরেজি নাম Little Spider Hunter বা ছােট মাকড়সা ভুক। সব ধরনের মাকড়সাই এদের প্রিয় খাদ্য, তাই এই নাম।

এক ঝড় কলাগাছ। পাশেই একটি টলটলে জলের ডােবা। একটি কলাগাছ ঝুঁকে আছে ডােবার দিকে, ডোবার জলে চমৎকার ছায়া পড়েছে। জলে ছােট ছােট ঢেউ। ফারুন মাসের বাতাস বইছে বেশ জোরে। কলার পাতাগুলােও দুলছে তালে তালে। ঝিঝির ডাকে ঝালাপালা কান। আমের বােলের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে বাতাসে। বড়সড় একটি আমগাছ ডালপালার তলায় ঢেকে রেখেছে কলঝাড়টিকে। ডােবার দিকে ঝুঁকে থাকা একটি কলাগাছে সুন্দর একটি মােচী কুলছে। ওই মােচাটায় তিন সারি ফুল ফুটে আছে দারুণ! মোচার তিনটি খােলা ওই ফুলকে যেন পরম যতনে আগলে রেখেছে ঢাকনা দিয়ে। খেলাগুলাে দেখতে অনেকটা ডিঙি নৌকার মতাে।

বেশ দূরে শােনা গেল জোরালাে ‘ট্রিক ট্রিক’ আওয়াজ। ওটা একটি পাখির ডাক। ডাকতে ডাকতে পাখিটি এগিয়ে আসছে বন-বাগানের তলা দিয়ে, ডালপালার ফাক গলে, ঘন সুপারি বাগানটার ভেতর দিয়ে। তীরবেগে এসেই ছােট পাখিটি বসে গেল কলার মােচাটায়। বসল ঝুলে, একটুও দেরি
করে মাথাটা একটু উঁচু করেই সুইয়ের মতাে সরু লম্বা ঠোটটি ঢুকিয়ে দিল একটি ফুলের ভেতর। কলাফুল তাে অনেকটা নলের মতাে। ওই নলের ভেতরের মধু সে জিভে টেনে খেতে শুরু করল। ঠোটটি লম্বায় ৫ সেন্টিমিটার। আগার দিকে একটু বাঁকানাে। সরু জিভটাও চেরা ধরনের।

ফুলের মধু টেনে খেতে তাই খুব সুবিধে। সেই সুবিধা নিয়েই পিচ্চি পাখিটি প্রথম ফুলটির মধু খেল। ঠোট বের করে ডাকল দুবার। তারপর একে একে সবগুলাে ফুলে ঠোট চুকাল। সব ফুলে মধু পেল না। হয়তাে-বা খেয়ে গেছে মােটুসী পাখিরা। ওরা তাে এই পাখিটির জাতভাই। ওদের ঠোটও পুঁচালাে । ভালােবাসে মধু খেতে।

যতবার পাখিটি ফুল থেকে ঠোট বের করল, ততবারই ডাকল। সবগুলো ফুল পরখ করা হয়ে গেলে ও উড়ল ঝট করে। মিলিয়ে গেল বন-বাগানের ভেতর দিয়ে আর থেমে থেমে ডাকতেই লাগল।
প্রায় আধা কিলােমিটার পথ পাড়ি দিল ও একই গতিতে। বসল এসে আরেকটি কলাগাছের পাতার ওপরে। পাতাটি ঝুঁকে আছে পুকুরের জলের ওপর। বড়সড় পাতা।

ওই পাতার ওপরে বসে একটুক্ষণ চুপ রইল পাতাটির দিকে তাকিয়ে। তারপর দু'পাখা ঝাকিয়ে, শরীরটা কাপিয়ে জোরে-জোরে ডাকতে শুরু করল, "ট্রি ট্রি ট্রি ট্র, ব্রিট ট্রিট, টিটু টিটু।' ধাতব আওয়াজ। একটু কর্কশ ধরনের। অমনি কলাপাতার তলার বাসা থেকে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়ল ওর সঙ্গী। পুকুরের টলটলে জলে সুন্দর ছবি এঁকে উড়ে এসে বসল কলাপাতার ওপরে । সরে এসে প্রথম পাখিটির গা ঘেঁষে বসল এবার।

পাখি দুটির ঠিক পায়ের নিচে বাসাটি। দুজনে কী যেন একটু পরামর্শ করল। তারপর প্রথম পাখিটি উড়েই ঘুরে এল পাতার তলায়, ঢুকে পড়ল। মাচানের মতাে তুলতুলে বাসাটির ভেতরে। বসে গেল ডিম বুকে নিয়ে। ডিমে তা দেবার পালা এবার তার। সুঁচালাে ঠোটটির প্রায় অর্ধেকটাই বেরিয়ে। আছে বাসার ফোকরের বাইরে। পাতার ওপরের পাখিটি এবার উড়ে চলে গেল দূরে। এখন সে খাবার খাবে। সময় হলে আবারাে ফিরে আসবে ডিমে। তা দিতে।

এই সঁচালাে ঠোটের ছােট পাখিটির নাম মােচাটুনি। কলাগাছে ফুল ফুটলে এরা আসবেই, কলাবাগান থেকে কলাবাগানে ঘুরে বেড়াবে কলাফুলের মধুর লােভে। বাসাও করে কলাপাতার তলায়। বসতেও ভালােবাসে কলাপাতার ওপরে। কলার মােচায় এরা চমৎকার ভঙ্গিতে বসে । কলাফুলের কাছে হােভারিং (শূন্যে স্থির থেকে ওড়া) করেও এরা সুন্দর ভঙ্গিতে। সুঁচালাে ঠোট ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে মধু পান করে অবাক কৌশলে। এদের নাম তাই মােচাটুনি। কলাটুনিও বলা যায়।

মাকড়সার জালের কাছে হােভারিং করে মাকড়সা ধরে মােহনীয় ভঙ্গিতে। আঁঠালাে জালে জড়ায় না কখনাে। এরা অত্যন্ত চঞ্চল, ভীতু স্বভাবের । বাংলাদেশের সব জেলাতেই আছে। বড় শহরে দেখা যায় না।

মােচাটুনি দেখতে মৌটুসী-নীলটুনির মতাে। আকারে একটু বড়। শরীরের মাপ ঠোটসহ ১৫ সেন্টিমিটার। শুধু ঠোটটিই ৫ সেন্টিমিটার অর্থাৎ গােটা শরীরের মাপের তিনভাগের একভাগ। ঠোটের গড়ন চমৎকার— আগার দিকটা বুকের দিকে কিছুটা বাঁকানাে, রঙ কালচে-সবুজ। এদের বুকপেট-লেজের তলার রঙ জলপাই-সবুজ, তাতে হাল্কা হলুদের আভা। বুক ও পেটের দু'পাশসহ লেজের গোড়াটায় হলুদ রঙ বেশি। মাথা-গলা-পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজের আগায় সাদাটে ভাব। পা কালচে। সূর্যের আলােয় মৌটুসী-নীলটুনির মতাে এদের শরীর তেমন ঝলকায় না, তবে চোখ দু'টি চকচকে।

ফুলের মধু, মৌমাছি, মাকড়সা ও মাকড়সার ডিমসহ নানান রকমের। পােকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খায়। নারকেলফুলে যখন মৌমাছি আসে, তখন এরা ওই মৌমাছিও ধরে। নারকেল ফুলের রেণু ও মধু এদের খুব পছন্দ। বাসা বাঁধে পৌষের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিক পর্যন্ত। কলাপতির।
মাঝখানটির তলায় চমৎকার মাচানের কায়দায় বাসা বানায়। বাসার মুখটা। থাকে পাতার আগার দিক বরাবর।

সরু ঠোটে পাতা ফুটো করে ওরা সরু সরু সুতাের মতাে উপকরণ। পাতার ওপর দিকে ওঠায়। তারপর পাতার ওপরে বসে ওই সুতাের মাথায় ঠোট দিয়ে ছােট ছােট গােল বল তৈরি করে। ওই গিটের জন্য সুতাের মাথা আর নামতে পারে না পাতার তলায়। পাতার মাঝখানের ডগায়ও অঁতাে খুঁজে দেয়। উগাটিকে মাঝখানে রেখে পাতায় আড়াআড়িভাবে বাসা সাজায়। বাসা ১৬-২২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার চওড়া। বাসার উপকরণ হচ্ছে পাটের আঁশ, মাকড়সার জাল, কলাগাছের শুকনাে আঁশ, শুকনাে সরু ঘাস ও অন্যান্য। বাসা বাঁধার জায়গা পছন্দে দু'জনে লাগায় ২-৬ দিন। আর বাসা বানাতে সময় লাগে ৪-৭ দিন। মানকচুর পাতা, কাঠবাদামের চারার পাতার তলায়ও বাসা করে। চমৎকার বাসাটি পাতার তলায় যেন সেঁটে থাকে।

ডিম প্রায়ই ২টি, দৈবাৎ ৩টি। দু'টি পাখিতে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৫-১৭ দিনে। হানারা উড়তে শেখে ১৯-২৩ দিনে। দর্জিরা যে কৌশলে হাতের দু'আঙুলে সুতাের মাথায় গিট দেয়, এরাও ঠোট ও জিভ ব্যবহার করে সুতোর মতাে উপকরণের মাথায় গিট দিতে পারে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url