বাংলাদেশের পাখি : মুনিয়া

বাংলাদেশের পাখি  মুনিয়া
বাংলাদেশের পাখি : মুনিয়া

শরৎকাল। একটি ছেলে স্কুলে যাচ্ছে। একা, দু পাশে টলমল জল ভরা বিল। ফুটে আছে সাদা শাপলা। এখানে-সেখানে কাশবন। ফুলে ফুলে সাদা। আকাশেও সাদা সাদা মেঘ। একজোড়া বালিহাঁস উড়ছে ডেকে ডেকে, ঘুরে ঘুরে।।
ছেলেটি আনমনা। হঠাৎ তার নাকের ডগা দিয়ে উড়ে গেল একটি সাপ। চমকে উঠে সে পেছন ফিরেই দিল দৌড়। উড়ন্ত সাপের কথা সে শুনেছে। বিশ্বাসও করে। সর্বনাশ! আরেকটু হলে তাে ছােবলই মেরে বসত।
পথ বেয়ে ছুটে সে বাড়ি এল। চোখ বড় বড় করে বাবাকে বলল ওই উড়ন্ত সাপের কথা। লম্বায় প্রায় দু হাত। সাপের মাথাটি লাল। লেজের দিকটা সাদা ও ফোলানাে। বাবা বললেন দুধরাজ পাখির কথা। ছেলেটি মানল না। বাবা বললেন দুধরাজ পাখির লম্বা, সাদা পালকের কথা। ছেলেটি বিশ্বাস করল না। বাবা তখন ছেলেকে নিয়ে চললেন বিলের দিকে। ছেলেকে বােঝাতে লাগলেন, পৃথিবীতে এমন কোনাে সাপ নেই, যারা পাখির মতন উড়তে পারে। কিন্তু ছেলে তার বিশ্বাসে অটুট। সে বলল, কীভাবে ছন্দে ছন্দে উড়ে সাপটি চলে গেছে হরগােজা ঝােপের দিকে। বাবা ছেলেকে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন হরগােজা কাঁটাঝােপের কাছে। তখনি ছেলেটি চিৎকার দিল- ওইযে সাপ ! বাবা দেখলেন। হাসলেন। বললেন, ওটা উড়ন্ত সাপ না, মুনিয়া পাখি। তারপর দু' জনে এগিয়ে ওই নিচু ঝােপের ভেতর বাসাও পেল। প্রায় শেষ করে এনেছে। চমৎকার গােলগাল বাসা। মাটি থেকে মাত্র হাতখানেক ওপরে। ছেলেটির ভয় কেটে গেল। জীবনে এই প্রথম সে মুনিয়া পাখি চিনল, লাল মুনিয়া। কী সুন্দর পাখি ! বাসাটিও কী চমৎকার ! | শুধু লাল মুনিয়াই না, বাংলাদেশে যে পাঁচ রকম মুনিয়া দেখা যায়, তারা সবাই কাশফুল-ঘাসফুল, ধান-ছন-খড় বা ঘাসের লম্বা সরু ফালি নিয়ে সাপের মতােই ওড়ে। মনে হয় উড়ন্ত সাপ। কেন এরকম মনে হয়? মনে হয় তার কারণ,

| ঠোট ও পা দিয়ে ধরে ওরা কাশফুল বা ঘাস নিয়ে উড়ে যায় দুলতে দুলতে। চমৎক
সেই দৃশ্য।।
| মুনিয়া ! নাম যেমন সুন্দর, ওরাও তেমনি সুন্দর। চড়ুইয়ের চেয়ে সামান্য। ছােট এই মুনিয়ারা অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের পাখি। বিশ্বের যেসব দেশে মুনিয়া আছে। তাদের সবার সাথে বাংলাদেশের মুনিয়াদের রয়েছে অভিন্ন কিছু মিল। যেমন সবার স্বভাব, ওড়ার ভঙ্গি, বাসার গড়ন ও ধরন, ডিম-বাচ্চার সংখ্যা মােটামটি একই রকম। খাদ্য, ডিম ফুটে বাচ্চা হবার সময়সীমাও বলতে গেলে এক। সবার ঠোট ত্রিকোণাকৃতির, ঠোটের গড়ন, ধরনও একই রকম। সবাই অল্পতে ভয়। পায়। যেমন, মুনিয়ার ঝাকের ওপর দিয়ে যদি শূন্যে বন্দুকের গুলি ছোড়া হয়। তাহলে ঝাঁক থেকে দু'চারটে পাখি ভয়ে মাটিতে পড়ে যায় অজ্ঞান হয়ে। আর ওদের সবার ডিম সাদা বটে, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই তা হাতির দাঁতের মতন সাদা, অথবা সাদা মুক্তোর মতন। ডিম গােল নয়, টিকটিকির ডিমের মতনই গড়ন, আকারে কিছু বড়। তবে, ডিমের খােসা খুব পাতলা, অল্পতেই ভেঙে যায়। সব ধরনের মুনিয়ার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফেসে, মনে হয় ডাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে কণ্ঠ। ওদের ভাল। মিষ্টি গান ওরা জানে। বাসা বাঁধার সময় খুশিতে ওদের গান বেড়ে যায়। পুরুষ পাখিই গান বেশি গায়। নাচার চেষ্টাও করে। বাসায় ডিম হলে, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুলেও পুরুষ পাখি খুশিতে টইটম্বুর হয়। এ সময় ওদের চেহারাই যায় পাল্টে। আরাে সুন্দর হয়। কিন্তু বাচ্চাদের যখন খাওয়াতে শুরু করে, তখন
স্ত্রী-পুরুষ দু'জনেরই চেহারা মলিন হতে থাকে। বাচ্চাদের জন্য খাবার যােগাড় করা কী চাট্টিখানি কথা। বাচ্চার সংখ্যা ৬/৭টি। খেতেও পারে বটে ওরা। মাবাবাকে তাই প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৭০ বার করে বাসায় আসতে হয় খাবার মুখে নিয়ে। বাচ্চারা ছােট থাকতে খিদে কম থাকে, পেটে জায়গাও থাকে কম। বাচ্চাদের বয়স ৭/৮ দিন যখন হয়, তখন মা-বাবা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে বাচ্চাদের পেট ভরাতে। এ সময় রাতেও বাচ্চারা মা-বাবার কাছে খান
চেয়ে কাঁদে। বাচ্চা ফোটার পর মা প্রথম প্রথম ৪/৫ দিন বাচ্চা বুকে বাসায় রাত কাটায়। তারপরে রাত কাটায় বাসার আশেপাশে। কেননা, বাসায় থাকলে মা বাচ্চারা মায়ের কাছে বায়না জুড়ে দেয় খাবার জন্য। ঠোট দিয়ে মায়ের ঠো, মাথায় আলতাে ঠোকর মারে, কাঁদে। মা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যায়।।
এবারে মুনিয়াদের একটি গড় হিসাব জেনে নেওয়া যাক। বাসা বাধার । নির্বাচনে ৫-৭ দিন ব্যয় করে। বাসা বাঁধতে গিয়ে ওরা কোনাে তাড়াহুড়ো
। ধীরে সুস্থে বাসার কাজ শেষ করে। বাসা শেষ করতে সময় লা°ে ১০ দিন। তারপরেও ডিম পাড়ার জন্য ২-৪ দিন অপেক্ষা করে। তবে
করে। তবে, ডিম।


পাড়া শুরু করলে ৬০ ঘন্টার ভেতরে সবক’টি ডিম পাড়া হয়ে যায়। খাদ্য উপকরণের উপরে এদের ডিমের রঙের প্রভাব অতি সামান্য হলেও পড়ে। তাই একই প্রজাতির মুনিয়ার ভিন্ন ভিন্ন বাসায় ডিমের রঙের কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। ডিমে তা দেয় মূলত স্ত্রী পাখি। ডিম ফুটে বাচ্চা হয় ১৪–১৭ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১৫-১৭ দিনে। বাসা ছাড়ার পরও বাচ্চারা প্রায় মাসখানেক মা-বাবার পেছনে পেছনে ঘােরে খাবার জন্য। নিজেরাও খায়। বাচ্চারা নিজেদের ভেতরে মারামারি করে না। বাসায় মা-বাবার মুখ থেকে আগেভাগে খাবার নেবার জন্য ঠেলাঠেলি অবশ্য কিছুটা করে। মুনিয়াদের বাসা একেবারে গােল, অথবা লম্বাটে ধরনের গােল। বাসায় ঢােকার পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারাে কারাে বাসার মুখ কিছুটা নলের মতাে বাইরে বেরিয়ে থাকে। বাসার আকার মােটামুটি একটা ছােটখাটো ফুটবলের মতন। বাসার উপকরণ ঘাস, ছন, খড়, কাশফুল, ঘাসফুল, দূর্বাঘাস, ধানের পাতা, আখের পাতা, বাঁশপাতা ইত্যাদি। নরম বাসা, ভেতরে চমৎকার নরম গদি করে। গদির জন্য তুলা, কাশফুল বা বাঁশের ছােট পাতা ব্যবহার করে। খাসা বাসা। উপকরণ নরম হলেও সুরক্ষিত বটে। শিকারি পাখিরা সহজে ডিম-বাচ্চা চুরি করতে পারে না। তবে বােকা বাচ্চারা যখন একটু বড় হয়, তখন শিকারি পাখিদের চালাকির ফাদে পড়ে যায় অনেক সময়। কাক-চিল ও হাঁড়িচাচারা আস্তে গিয়ে বসে বাসার পাশে। তারপরে গলায় তােলে অত্যন্ত মিহি আওয়াজ। বাচ্চারা ভাবে, মা-বাবা খাবার মুখে এসেছে। দরজাপথে মাথা দেয় বাড়িয়ে। কপাৎ করে মাথা ঠোটের ফাঁকে ধরে শিকারি পাখি যায় উড়ে। তখন এমন অবস্থা হয় যে, অন্য বাচ্চারা মা-বাবা এলেও বাসা থেকে মাথা বের করতে চায় না। ভয় পায়। তবে, শিকারি পাখিদের মতলব প্রায় সময়ই এজন্য কাজে লাগে না যে, মুনিয়ারা বাসা করে দুর্গম জায়গায়। যেমন খেজুর বা তাল পাতার ঘন পাতাওয়ালা মাথার ভেতরে, নাটাঝােপ ও হরগােজার কাটাঝােপ, কেয়াঝােপ, বাবলা গাছ ও শেওড়া গাছে। ঢাকা শহর ও আশেপাশে এখন যে বিদেশী দেবদারু গাছের (উইপিং দেবদারু বা ঘােমটা দেবদারু) সারি নজরে পড়ে, মুনিয়ারা ওই গাছের ভেতরেও বাসা করে। ঘন ডালপালা ও পাতাওয়ালা জায়গায়ই ওদের পছন্দ, পছন্দ দুর্গম জায়গা। তবে, অপেক্ষাকৃত খােলা জায়গাতেও ওরা বাসা করতে পারে। ওরা বেশ আলসে, যেন কোনাে কিছুতেই তাড়াহুড়াে দেখা যায় না। মানুষকে খুব বেশি ভয় পায় না। শত্রুকে প্রতিহত করতে জানে না। ডিমখেকো সাপেরা অনেক সময় ওদের বাসায় ঢুকে ডিমবাচ্চা সাবাড় করে। আবার গেছােইদুর ও কাঠবিড়ালেরা অনেক সময় ওদের বাসা দখল করে নেয় রাতে বা দিনে নিশ্চিন্তে ঘুমানাের জন্য। উল্লেখ্য যে,


গেছােইদুর ও কাঠবেড়ালের বাসার সাথে মুনিয়ার বাসার অনেক মিল আছে।। গড়ন-ধরন প্রায় একই রকম।
১. লাল মুনিয়া ( Red Munia) : লম্বায় ১০ সেন্টিমিটারের একটু বেশি। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম। চোখের রঙ দেখে অথবা ডিম-বাচ্চা হবার সময় পুরুষকে আলাদা করে চেনা যায়। আমাদের মুনিয়ার ভেতর এ হচ্ছে। সবচেয়ে ছােট। পাশাপাশি সবচেয়ে সুন্দর। টুকটুকে লাল এক পাখি সে। লেজের তলায় আবছা কালাে ছােপ আছে। মাথা-ঘাড়-কপাল-পিঠ আলতা লাল। বুজানাে অবস্থায় ঘাড় লাল। ডানার ওপরে সাদা সাদা অতি সুক্ষ ছিট। এজন্য দেখতে আরাে বাহারি লাগে। আদুরে চেহারা। মায়াবী চোখ। বুক ও ঘাড় লাল। লম্বাটে ধরনের লেজ। লেজের পালকের আগায় আবছা সাদার টান।। পুচ্ছ একেবারে পুঁইফুলের মতন লাল। লেজের আগা কেউ যেন গােল করে হেঁটে দিয়েছে। ঠোট লাল। চোখের মণি লালচে পাটকিলে। উড়লে পিঠের। নিচের দিকটা হালকা লালচে বাদামি। বাসা বাঁধার সময় পুরুষের শরীর দেখে। মনে হয় রক্তজবা ফুলের রঙ মেখে নিয়েছে সারা শরীরে। স্ত্রীর গলা ও চিবুক কিছুটা ফ্যাকাসে। বৈজ্ঞানিক নাম Estrailda amandava.
স্ত্রী লাল মুনিয়াও সুন্দরী। লেজের উপরের পালক পুরুষের মতন লাল।। লেজের আগা কিছুটা সাদা। স্ত্রীর চোখের ঠিক সামনে অতি সূক্ষ একটু কালাে দাগ আছে। এই চিহ্ন দেখে স্ত্রী চেনা সম্ভব। তার বুক-পেট ফ্যাকাসে লালচে। সব মিলে লাল মুনিয়ারা সাদা ফুটকিওয়ালা এক অতি সুন্দর পাখি।


ডিম হয় প্রায় সময় ৬টি। ৪, ৫, ৭ সংখ্যা কখনাে কখনাে হয়। বাংলাদেশের আশেপাশের যেসব দেশে লাল মুনিয়া আছে, আবহাওয়া ভেদে তাদের রঙের পার্থক্য রয়েছে। ঘাসবন, জলাভূমির হােগলা-গােলবন-হরগােজার ঝােপ, নলখাগড়ার ঝােপই পছন্দ। নদীর পাড়ের কাশবন-শনক্ষেত বেশি পছন্দ। আখক্ষেতেও থাকে। আমাদের দেশে এরা সংখ্যায় খুবই কম। সুন্দরবনে আছে। আছে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বাসা বাঁধার সময় গান বেশি গায়। ছােট ছােট দলে থাকে। সামাজিক পাখি। বাসা করে অপেক্ষাকৃত নিচুতে। সুন্দরবনের গােলবনেও বাসা করে। কণ্ঠস্বর কিচ কিচ ধরনের।
২ তিলা মুনিয়া (Spotted Munia) : আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আছে। সারা দেশেই আছে। ঢাকা শহর, সাভার জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও আছে। বাসাও খুঁজে পাবে উৎসাহী শিশু-কিশােরেরা। পুরাতন বিমান বন্দর এলাকা ও জিয়া বিমান বন্দরের আশেপাশের ঘােমটা দেবদারু গাছে সময় মতাে বাসাও পাওয়া যায়। তিলা মুনিয়া লম্বায়। প্রায় ১২ সেমি.। বুক-পেটের পাশ জুড়ে বুজানাে ডানার তলায় কালচে-বাদামি রঙের চিত্র-বিচিত্র চমৎকার কারুকাজ—যেন কোনাে চিত্রশিল্পী দ্বিতীয়ার চাঁদের মতন নকশা এঁকেছে। ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। লেজের উপরিভাগে কালাে। ও হলুদের সােজা চওড়া টান—যেন কেউ সরু কালাে ও লালচে হলুদ ফিতা সেঁটে দিয়েছে একের পর এক। লেজের উপরিভাগের গােড়াটা হলুদ। লেজের তলা


সাদাটে। চিবুক-গলা-ঘাড়-মাথা গাঢ় কালচে-বাদামি। বুক ও পেট ভs হালকা হলুদাভ, তার উপরে যেন সাদা ছিট লাগানাে। লেজের আগা চোখা। ৪ বাঁধার সময় আনন্দে পুরুষ পাখির রূপ খােলে। অন্য সময় স্ত্রী-পুরুষ আলাদ। করা কষ্ট। কম বয়সী বাচ্চার রঙ হালকা বাদামি। চোখের মণি হালকা লাল তাতে বাদামির আভা। কণ্ঠস্বর হচ্ছে কিরিটি চিরিটি, চিট্টি-কিটিকিটরি কিচ কিচ। এদের ডিম হয় প্রায় সময় ৬টি। ৮টিও হয়। আবার ৪টিও দেখা যায়। বাসা একেবারে গােল না। অনেকটা নারকেলের মতন। বড় ঝুঁকে থাকে। আবার ছােট ঝাকেও থাকে। শুকনাে জায়গা পছন্দ। বাসা করে মানুষের হাতের নাগালের ভেতর বা তার চেয়ে কিছুটা উপরে। মাটিতে নেমেও খাবার খায়। ধান। ঘাসের বীজ, বাদামের দানা, এমনকি মানুষের ফেলে দেওয়া পাউরুটি বিস্কুটের কণাও খায়। কোনাে মুনিয়াই মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। লাফিয়ে। লাফিয়ে চলে। তিলা মুনিয়াও তাই করে। এই উপমহাদেশে আবহাওয়া ভেদে এদেরও রঙের কিছুটা তারতম্য হয়ে থাকে। এক গাছে বা পাশাপাশি দুতিন জোড়া পাখির বাসাও দেখা যায়। শরীরে ছিট থাকে সরার। বৈজ্ঞানিক নাম L. Punctulata.
৩. কালােমাথা মুনিয়া (Blackheaded Munia): লম্বায় ১১ সেমি.। সাদা-কালাে এক চমৎকার পাখি। স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। মাথা, চিবুক, গলা ও বুকের কিছু অংশ কালাে। বুকের নিচ থেকে পেট ও লেজের তলা পর্যন্তও কালাে। বুক সাদা, দু'পাশে কালাে। দেখতে তাই ভারি সুন্দর লাগে। ঠোট আবার হালকা নীল। সুন্দর চোখ। বুজানাে ডানার উপরিভাগসহ লেজের উপরিভাগের কিছুটা গাঢ় লালচে-খয়েরি। বাকি উপরিভাগ কালচে। চকচক করে যেন। পায়ের রঙ উজ্জ্বল ধাতব। কণ্ঠস্বর ছিক ছিক। এরা রােদে গেলে যেন জ্বলে। ডিম হয় প্রায় ৫টি। ৭টি পর্যন্ত হয়। এদের পছন্দ পাহাড়ি এলাকার বনবাগান ও বনের আশেপাশের খােলা ক্ষেতখামার। এরা বেশ লাজুক ধরনের। ঘন বনবাগান ও পছন্দ। সুন্দরবনে নেই। এদের বাসা সব মুনিয়ার মধ্যে বড়। ঘাসবন, ছােট ঝােপঝাড় ও অন্যান্য ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ভেতরে বাসা করে। নিচুতেই রাত কাটাতে এরা ভালবাসে। বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura Malacca.
৪. সাদাগলা মুনিয়া (Whitethroated Munia); লম্বায় ১১ সােমর। একটু বেশি। তিলা মুনিয়ার পরেই বাংলাদেশে এদের সংখ্যা বেশি। কণ্ঠস্বর বেশ কর্কশ-চিট ছিট চিট চিট্টি ধরনের। গলা, বুক, পেট ও লেজের প্রায় অর্ধেকতা সাদা। লেজের তলার বাকিটা কালাে। লেজের উপরে এক ছােপ সাদা। ঠোটকপাল-পিঠ বাদামি ও হালকা বাদামি। চোখের পাশ থেকে ঘাড় হলদেটে-লাল। বুজানাে অবস্থায় ডানার কিনারা কালচে। লেজ লম্বাটে ও চোখা ধরনের। এদের


ঠোট অপেক্ষাকৃত ছােট ও হালকা ধরনের। গােলাপি পা। এরা আলসে ও মিশুক। এক বাসায় অন্য মুনিয়ারাও ডিম পাড়ে। তা-ও দেয়। অতগুলাে ডিমে কি আর উত্তাপ ঠিকমতন লাগে। সব ডিম তাই ফোটে না। এদেরও ডিম প্রায় সময় হয়। ৬টি। ৪/৫টিও দেখা যায় কখনাে কখনাে। তিলা মুনিয়ার মতন এরাও শুকনাে জায়গা পছন্দ করে। জোড়ায় জোড়ায় শরীর মিলিয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে বসে থাকে। এর বৈজ্ঞানিক নাম L. Malabarica.
৫. সাদাপিঠ মুনিয়া (Whitebacked Munia): লম্বায় প্রায় ১১ সেমি.। ঠোট চমৎকার নীলাভ। বুক চৌকাসাদা, মনে হয় কোনাে চিত্রশিল্পীর চমৎকার কারুকাজ। পিঠে চওড়া সাদা একটা টান। লেজ কালাে ও বেশ চোখা ধরনের। মাথা, চিবুক, ঘাড়, বুক গাঢ় কালচে। তাতে বাদামির আভা। লেজের তলার পালক হালকা পাটকিলে। পা শ্লেট পাথরের মতন। কণ্ঠস্বর চিপ চিপ ধরনের। চোখের মণি গাঢ় পাটকিলে। দূর থেকে দেখলে কালােমাথা মুনিয়া বলে ভুল হতে পারে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম, বসার ভঙ্গি দেখেই পার্থক্য জানা যায়। এদের সংখ্যাও আমাদের দেশে খুব বেশি নয়। ডিম হয় প্রায় সময় ৫টি। ৪ ও ৬ এর সংখ্যা কম। একবার আমি একটি বাবুইয়ের বাসা উঠোনের বরই গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। ওর ভেতরেই ডিম দিয়েছিল মুনিয়া। প্রথমে ভেবেছিলাম বাবুই বুঝি ফিরে এসেছে। পরে চিনলাম ওরা সাদাপিঠ মুনিয়া। এরাও আলসে। সুযােগ পেলে একই জাতের অন্য মুনিয়ার বাসায় ডিম পাড়ে। বাসা বাঁধার কষ্ট স্বীকার করতে চায় না। বৈজ্ঞানিক নাম L. Striata.
এছাড়াও শীতে আমাদের দেশে বেড়াতে আসে সবুজ মুনিয়া। জলপাইসবুজ তার রঙ। লম্বায় প্রায় ১০ সেমি.। বুক, পেট ও লেজের তলা হলুদ। লাল টুকটুকে ঠোট। কালাে লেজ। গােল ধরনের বুকের পাশ ঘেঁষে উপর থেকে নিচের দিকে চমৎকার সবুজ-পাটকিলে কিছুটা বাঁকা টান। ওই টানের জন্য ভারি সুন্দর লাগে পাখিটিকে।
সব ধরনের মুনিয়া পােষ মানে। নিয়মিত গােসল করে। সবার ডিম সাদা, বাসা গােলাকার। সবাই সামাজিক। দলে থাকে। তবে জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হয়ে বসে। উৎসাহী শিশু-কিশােরেরা ঢাকা চিড়িয়াখানায় গেলে মুনিয়া দেখতে পারে। অনেকেই হয়তাে বিমান বন্দর থেকে আটক করা কালােমাথা ও লাল মুনিয়াও চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখে এসেছে। মুনিয়া বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। তবে, সবার উচিত ওদেরকে না কেনা। বরং ওরা যাতে খাঁচাবন্দি হয়ে পাখিওয়ালাদের কাছে না থাকে সেজন্য সােচ্চার হওয়া উচিৎ। কেননা, মুনিয়া। পরিবেশের পরম উপকারী বন্ধু। মানুষেরও বন্ধু।।


খুঁজে দেখতে পারেন।
৬. হলদে মাথা খঞ্জন (Yellow Headed Wagtail) ১৭ সেমি লম্বা। মাথা চিকন। গলা, পেট, রানের পালক চকচকে হলুদ। মায়াবী চোখ। লেজের তলার পালক হালকা হলুদ। পিঠ ও লেজের উপরিভাগ ঘন কালাে। বুজানাে পালকের প্রান্তে এক ছােপ সাদা ও পিঠের শেষ প্রান্তে কয়েকটি সাদা টান। লেজের পাশের পালক সাদা। ঠোট কালাে।
| সুন্দর পাখি। হলুদ খঞ্জন ও তাদের উপপ্রজাতির সাথে এর পার্থক্য নির্ণয় ধরা বেশ কঠিন। এদের পছন্দ জলাভূমি। জলপিপির মতন এরাও জলজ শাপলা পদ্ম ও অন্যান্য জলজ গুলু কচুরিপানার ওপর দিয়ে লেজ নাচিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঢােড়া সাপের কবলে পড়ে অনেক সময়। বাসা করে ওই জলাভূমির ঝােপঝাড় বা কচুরিপানার ভেতরে। বাটির মতন বাসা। কচুরিপানার শুকনাে শিকড অপরিহার্য উপকরণ। ডিম হয় ৩৫টি। বড় হলুদ খঞ্জনের মতাে।
| এরকম আরেকটি খঞ্জন হচ্ছে কালাে পিঠের হলুদ মাথা খঞ্জন। এদের। পিঠ ঘন কালাে, মাথা হলুদ। স্বভাব ওই হলুদ খঞ্জনের মতাে।
৭. বনখঞ্জন (Forest Wagail) লম্বায় ১৬ সেমি.। প্রথমেই নজরে পড়ে এদের বুকের কালাে চওড়া দু’টি দাগ। বুক-পেট সাদা। লেজ পাটকিলে কালাে। অন্য খঞ্জনদের মতাে লেজের দু পাশের পালক সাদা। মায়াবী চোখ। চোখের ওপরে সাদা কাজলের একটু বাঁকা টান। ডানার প্রান্তের পালক আবছা হলুদ। ঘাড়ের দু পাশ জলপাই রঙা। কণ্ঠস্বর অন্য খঞ্জনদের মতন। ডিম ২–৫টি। এরা বাসা করে কিছুটা লম্বাটে। অপেক্ষাকৃত কম ঝােপ-ঝাড়ের তলায়, ঘাসবনে বা ঘন জঙ্গলের গাছের গােড়ার খোদলে। বৈজ্ঞানিক নাম M. Indica.
এ ছাড়াও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানান রঙের উপজাতি। সবাই সুন্দর। উৎসাহীরা ইচ্ছে করলেই ঢাকা শহর, তার আশপাশ ও বাংলাদেশের সবত্রই কমবেশি এই সব পর্যটক পাখিদেরকে দেখতে পাবেন। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থেকে ওরা ফিরে যায়, যার যার ঠিকানায়। বাসা করে। ডিম-বাচ্চা তােলে। আবারও ফেরে। এই যে যাওয়া-আসা, তা যেমন ওদের নিজেদের প্রয়ােজনে, তেমনি প্রকৃতির ইঙ্গিতে। এরা আসে আমাদের দেশে প্রকৃতিরই মঙ্গল করার জন্য। তাই আমরা ওদের সােন্দহ। দেখে চোখ জুড়াব, মন ভরাব। কখনাে কষ্ট দেব না।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url