বাংলাদেশের পাখি : কমলা দামা

বাংলাদেশের পাখি  কমলা দামা
বাংলাদেশের পাখি : কমলা দামা

পদ্ম পাতার মতন গােলগাল একটি পুকুর। চারপাশ ঘিরে বড় বড় গাছ। ঝােপঝাড়। মাঘ মাস। জল নেমে গেছে। ওই জলের কিনারা ধরে ছােট ছােট লাফে এগিয়ে চলেছে সুন্দর একটি পাখি। আকার আকৃতি দোয়েলের মতন। দেখতেও প্রায় একই রকম। রঙটা ভিন্ন। লাফালাফির কায়দাও একই রকম। তবে, এর লাফের যেন আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। দোয়েলের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতাও আছে। তার লাফ দেওয়ার মধ্যে তাল-লয়-ছন্দ আছে চমৎকার। লাফের সময় বুকটা টানটান হচ্ছে। নাচতে নাচতে এগােচ্ছে সামনে। পরপর তিন-চারটি লাফ দিচ্ছে, একটু থামছে। মাথা ঘুরিয়ে পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ খুজছে। জলের কিনারে কেঁচো বা ছােট ব্যাঙ আছে কিনা তাও দেখে নিচ্ছে। তারপর আবারও নেচে নেচে দিচ্ছে তিন-চারটি লাফ। আবারও থামা। খাবার খোজা। ওর যেন কোনাে তাড়া নেই। কোনাে দুর্ভাবনা নেই। শেষ বেলায় যদি কিছু জুটে যায়, খাবে । না জুটলেও অসুবিধা তেমন নেই। সূর্য। ডুব দিয়েছে। মাঘের শীত নামতে শুরু করেছে চরাচরে। পাখিটার কোনাে তাড়া নেই তবু। জলের কিনার দিয়ে যাচ্ছে বলেই তার ছায়া দেখা যাচ্ছে। জলে। চমৎকার দৃশ্য। যেনবা ওপরে-নিচে দুটো পাখি।

এভাবেই পুকুরটা একপাক ঘুরে এল সে। যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, ঠিক সেখানে এসেই থামল। এখানে ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে। বৃত্তাকারে সে ঘুরে এসেছে। ও জানে, আর ঘুরে লাভ হবে না। যে পথ ধরে সে এসেছে, সে পথে আর কোনাে খাবার মিলবে না। এই যে এক পাক ঘুরে আসা, এর ভেতরে তার নাচের ছন্দপতন ঘটেছে মাত্র চার বার। চার বারের ভেতর তিন বার পেয়েছে তিনটি ছােট ছােট পােকা। একবার একটি কেঁচো। ওই চার বার ছাড়া তার নেচে নেচে এগুনাের তাল-লয়-ছন্দ ঠিকই ছিল। তিন থেকে চারটি লাফ। প্রতি লাফের দূরত্ব সমান। ৮ সেন্টিমিটার। ওর থামার সময়টাও ছিল অংকে বাধা। ৫ থেকে ৭ সেকেণ্ড। আবারও লাফ। লাফের গতি ওদের বেড়ে যায় পােকামাকড়কে ধাওয়া করে ধরার সময়। এমনিতে ওরা আয়েশি ভঙ্গিতে এগােয়। সব সময় চালচলনে একটা গােবেচারি ভাব। ভদ্র স্বভাব। চাহনিতে ভীরুতা ফুটে থাকে সব সময়। মায়াবী চোখ দুটো একটু যেন ভাসা ভাসা। অমন সুন্দর চোখ বাংলাদেশের খুব কম পাখিরই আছে। লাফিয়ে চলার পথে কোনাে শিকারই তার নজর এড়ায় না। সাপের ছােট বাচ্চা পেলে সে অপূর্ব কৌশলে মেরে ফেলতে পারে। সাপের বাচ্চার লেজে ঠোট চালায়। সাপের বাচ্চা লেজের দিকে ঘােরে। তখন আবারও লেজে ঠোট বসায়। কখনাে মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করে না। আর যদি একজোড়া পাখি থাকে তাে, দু’টিতেই আক্রমণ। করে একসঙ্গে। এক্ষেত্রেও লক্ষ্য থাকে লেজ। আবার রক্তচোষা বা গেছাে ছােট গিরগিটি, কাকলাস বা আঞ্জনের বাচ্চা পেলে দু’টি পাখিতে মিলে অনেক সময় আরেক কৌশল খাটায়। একটিতে ধরে মাথা। অন্যটিতে লেজ। টানাটানি করে টানটান করে ফেলে। টানটান করে ধরে রেখে বৃত্তাকারে ঘােরেও অনেক সময়।

সে এক মজার দৃশ্য। এই দৃশ্যটি আরও মজাদার হয় তখন, যখন কেবল বাসা। ছাড়া তিন-চারটি বােকা বােকা চেহারার বাচ্চা মিলে ওরকম টানাটানি করে।। সত্যিই সে এক দেখার মতাে দৃশ্য। অন্য শিকার পাকড়াও করতে তেমন বেগ পেতে হয় না ওদেরকে। ডানাওয়ালা পােকা বা কীট, অথবা পলাতক ঘাস ফড়িংকে ধাওয়া করে দু ডানার বাতাস সামনে ঠেলে দিয়ে ওরা শিকারকে বাতাসের একটা পাকে ফেলে দেয়। তারপর চেপে ধরে ঠোটের ফঁাকে। তবে, দোয়েল, শ্যামা বা নাচুনে পাখির মতন পলাতক শিকারকে দ্রুত ধাওয়া করতে পারে না। 

একপাক ঘুরে এসে থামল পাখিটি। এদিও-ওদিক তাকিয়ে বােধ হয় আলাের পরিমাপ করে নিল। আরেক পাক ঘুরে আসার সময় আছে বুঝে সে আবারও লাফ শুরু করল। তবে এবার রুট গেল বদলে। এবার আর জলের কিনারা ছুঁয়ে নয়। হাত দুই ওপরে উঠল সে প্রথমে। তারপরে চলতে শুরু করল। আশ্চর্য ! সে চলতে লাগল সামনের দিকে। জলের কিনারা থেকে দূরত্ব সমানই থাকছে। জলের কিনারা ছুঁয়ে তাে সে একপাক ঘুরে এসেছে। ওই রুটে এগিয়ে লাভ নেই। দু' হাত ওপর দিয়ে আরেক পাক ঘুরবে সে। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে দ্রুত। পাখিটার গতি কিন্তু দ্রুত নয়। সেই ৮ সেমি.। সেই ৫-৭ সেকেণ্ড ।

মােটা একখানা গাছের গুড়ি পড়ে আছে। ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় পাখিটির নজরে পড়ল কালাে একটি কেঁচো। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে ঠোটে চেপে ধরল ওকে। মাটির ভেতরে ছিল কেঁচোর আধখানা শরীর, বের করে আনল একটানে। বড়সড় মােটা কেঁচো। পালাতে ব্যস্ত। পাখিটি চাইছে ওকে ভালমতন কৰ্জা করতে। এ সময় একটি সাদাবুক মাছরাঙা সঁ করে নেমে এল পাখিটির মাথার ওপরে। চাটি দেবার ভঙ্গি করে উড়ে গেল আবার। পাখিটি ঘাবড়ে গেলেও কেঁচো ছাড়ে নি। সাদাবুক মাছরাঙারও প্রিয় খাদ্য ওই কেঁচো। সুন্দর পাখিটি ঠোটের ফঁাকে চেপে ধরে কেঁচোকে আছড়াতে শুরু করল। একটু বাদে কেঁচোর নড়াচড়া গেল থেমে। খুশি খুশি চোখে পাখিটি গিলতে শুরু করল কেঁচো। সিকিভাগ গেলার পরে মাথা উঁচু করল সে, কেননা, গিলতে অসুবিধা হচ্ছে। এসময় ধমক-ধামক মারতে মারতে ধেয়ে এল একটি পুরুষ-দোয়েল। ভড়কে গিয়ে পালাতে চাইল সুন্দর পাখিটি। খপ করে দোয়েল ধরল কেঁচোর অন্য প্রান্ত। ব্যস, শুরু হল টানাটানির খেলা। মজাদার খাবার ছাড়তে চাইছে না কেউই। নাছােড়বান্দা দোয়েলও ওটা ছিনতাই না করে ছাড়বে না। আচমকা উঁচু পাড় থেকে লাফিয়ে নামল একটি খাটাস (Large Indian Civet)। থাবার নিচে চাপা পড়ল দোয়েল। ভয়াত চিৎকার দিল। সুন্দর পাখি কেচো মুখে বোকাট্টা। খাটাসের কবজায় দোয়েল। চেঁচাচ্ছে তারস্বরে। সন্ধেবেলায় খাবার ছিনতাই করতে এসে নিজেই সে খাটাসের খাবার হয়ে গেল। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম।

খাটাসটি চলে গেল। সুন্দর ওই পাখিটি সােনালুর ডাল থেকে জলের কিনারে নামল। জল পান করল। তারপর ওখানে বসেই দ্রুত পালক প্রসাধন সেরে নিল। শরীরে প্রচণ্ড একটা ঝাকুনি দিল। ডানা মেলল। বসল এসে একটি আমগাছের ডালে। পাশেই একটি নিমগাছ। সেই নিমগাছ থেকে মােটা একটা বুনােলতা এসে আমের ডাল জড়িয়ে ধরেছে। পাখিটি বসল ওই লতার ওপরে। উত্তরমুখাে হয়ে। মাথার ওপরে আমপাতার একগুচ্ছ ছাতা।

শীতকাল। তবু কেন ও উত্তরমুখাে হয়ে বসল ? এখন তাে বয় উত্তরে কনকনে হাওয়া। এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে দক্ষিণমুখাে বসলে বাতাসে ওর পালক উড়বে, শীত বেশি লাগবে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে আমি দেখেছি, পুরাে শীতকালটাই ওরা উত্তরমুখাে হয়ে বসে। শরীরের পালক ফুলিয়ে রাখে। এই যেমন—এই পাখিটিও পা গুটিয়ে, পেট লতায় মিশিয়ে বসেছে, শরীরের পালক ফুলিয়ে কেমন যেন। টেনিস বলের আকৃতি নিয়েছে। মাথা ঘুরিয়ে ঠোট গুঁজে দিয়েছে পিঠের পালকের ভেতরে। ও যেন বসতে না বসতেই ঘুমের দেশে চলে গেছে। আমার অভিজ্ঞতা এই বলে যে, ওরা খুব ঘুমকাতুরে। গাঢ় ঘুম ওদের। রাতের আশ্রয়ে ওভাবে থাকা অবস্থায় আমি বহুবার ৫ সেলের টর্চের আলাে ফেলেছি। কখনাে ওরা। পিঠ থেকে মুখ তােলে নি—একটুও নড়াচড়া করে নি। হাততালি বাজালে অবশ্য একটু চমকে ওঠে, পিটপিট করে তাকায়। কিন্তু পালাতে চায় না সহজে। এমনিতে ও মানুষকে তেমন ভয় পায় না। খুবই নিরীহ পাখি। মাটিতে নেমে যখন লাফায়, তখন ওর খুব কাছাকাছি (এক মিটার) যাওয়া সম্ভব। ওর চোখ। খুব সুন্দর। টলমল। ওই চোখে মায়া আছে। ভালবাসার সাড়া আছে। চোখে সব সময় যেন ভয় ফুটে থাকে। আসলে সে অতটা ভীরু নয়। পাশাপাশি সাহসীও নয়। এমনকি বাসা-ডিম-বাচ্চাদের রক্ষার জন্য সামান্যতম প্রতিরােধও ওরা গড়তে পারে না। বাসার কাছে মানুষ প্রাণী যা-ই আসুক, ভয়ে পালাবে। ওদের প্রবণতা এরকম যে, বাসা বাধবে মানুষ চলাচলের পথের পাশের কোনাে গাছে। আর সব সময় চেষ্টা করবে ফিঙে, ধৌলি ফিঙে, বুলবুল, হলদেবউ, দুধরাজ ও লেজনাচুনে পাখির বাসার ধারে-কাছে বাসা বাঁধতে। এটা এক রকমের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। শত্রু এলে নিজে তাে পালায়, উল্লেখিত পাখিরা ধেয়ে আসে। ফঁকতালে নিজের বাসা-ডিম-বাচ্চাও রক্ষা পায়। আর রাতে। আশয় নেবে একা। এক জায়গায় ৪/৫ রাতের বেশি থাকবে না। রাতের আশ্রয়স্থলটা খুব হিসাব কষে নির্বাচন করে। যেমন এই বুনােলতা। লতা বেয়ে। | সাপ-বনবিড়াল বা গেছাে খাটাস (Palm Civet) যদি পাকড়াও করতে আসে, টের পেয়ে যাবে। আমপাতার ছাতার জন্য মাথায় শিশির পড়বে না। তাই বলে সে যে খুব চতুর পাখি, তাও বলা যাবে না। আবার বেজি বা অন্য কোনাে শিকারি প্রাণী তাকে সহজে ধরতেও পারে না। আমার বহুবার মনে হয়েছে, হাত বাড়ালেই খপ করে ধরা যাবে। ধরতে কোনাে দিন পারি নি। এই পাখিটি তার খাদ্যের ৯৮ ভাগ সংগ্রহ করে মাটি থেকে। দুই ভাগ গাছপালা থেকে। বর্ষাকালে বন-বাগানে লাফানাের সময় মাঝে-মধ্যে সাপ, গুইসাপ, বেজি ও বনবিড়ালের কবলে পড়ে। এদের জীবনটা খুব নরম। অল্প আঘাতেই মারা যায়। মাটিতে লাফানাের সময় সতর্ক নজর রাখে চারপাশে। তবুও বাঁচতে পারে না সব সময়। গলায় শব্দ তুলে এরা বাচ্চাদের সতর্ক সংকেত দিতে জানে । তাই সঙ্গের বাচ্চাদেরও বাঁচাতে পারে না সব সময়। ওড়ার ভঙ্গি ও চাহনিতে এরা সতর্ক সংকেত ফুটিয়ে তােলে। আর এদের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্য কোনাে পাখির সঙ্গে এরা কখনােই ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে না। অন্য পাখিরা তাই এদেরকে ভাল চোখে দেখে। যদিও দোয়েল, ফিঙে, শালিক ও নওরঙ পাখিরা এদের খাদ্য ছিনতাই করে থাকে।

নিরীহ, ভদ্র ও সুন্দর এই পাখিটির নাম কমলা দামা। ইংরেজি নাম হচ্ছে Orange Headed Ground Thrush. একে দেখতে দোয়েলের মতাে লাগে বলে, মাটিতে চরে বলে বাগেরহাট জেলায় এর নাম ‘মাইটে দোয়েল’। বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Zoothera citrina. Turdinae বংশের এই পাখির প্রজাতির-উপপ্রজাতির সংখ্যা অনেক। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানান রকম কমলা দামা।

পুরুষ কমলা দামা দেখতে বেশি সুন্দর। মায়াবী চোখের রঙ টলমল নীল জলের মতাে। তাতে একটু কালচে পিঙ্গলের আভা। ঠোট হাল্কা গােলাপি। তাতে মাংসল নীলচে ছাই ও পিঙ্গলের আবছা ছায়া। মাথার চাদি, ঘাড়-গলাবুকের রঙ গাঢ় কমলা। তাতে হাল্কা হলুদের ছোঁয়া যেমন আছে, তেমনি আছে। লালচে আভা। পেট ও লেজের নিচের রঙ হচ্ছে সাদাটে ও হাল্কা হলুদ। বুজানাে। অবস্থায় পিঠের রঙ ছাই। লেজের ওপরের রঙও তাই। ডানার প্রান্তে, চোখের নিচ বরাবর পরপর তিনটি সাদা গােলাকার ছােপ আছে। ওড়ার সময় ভাল নজরে আসে। পায়ের রঙ হালকা গােলাপি। লেজের প্রান্ত গােলাকার ধরনের। সব মিলে তাকে সামনে থেকে কমলা রঙের দেখায়। পেছন থেকে ছাই রঙা। দেখায় শুধু গাঢ়-মাথাই কমলা দেখায়। স্ত্রীরাও ভারি কমলাসুন্দরী। তবে, পুরুষের তুলনায় কম। বাসা বাধার সময় ছাড়া দু’টি পাখিকে সাধারণত এক জায়গায় চরতে দেখা যায় না। ছায়া ছায়া বনবাগানই প্রিয়। খােলা মাঠেও প্রয়ােজনে যায়। ভয় না পেলে খুব উঁচু গাছে কখনাে বসে না। এদের নখর বেশ ধারালাে। শিকার একটু বড় হলে নখ চালায়। শীতকালে আমাদের দেশে অন্য আরেকটি কমলাদোয়েল খুব কম সংখ্যায় আসে। ওদের গলার ও চোখের নিচটা সাদা। কালচে দু’টি টানও আছে। বাংলাদেশের কমলা দামা দের ওই সাদা বা কালাে টান নেই। এইটুকু মনে রাখলেই দু’টিকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকবে না। শীতে কমলা দামা বেশি উজ্জ্বল, সাহেব সাহেব ভাব। আমাদের কমলা দামা খাটি বাঙালি। আলাদা সৌন্দর্য আছে তার। বাঙালি কমলা দামা লম্বায় ২২ সেন্টিমিটার। সাহেবটা ২৩ সেমি.। বাঙালি কমলা দামা বাড়িঘরের আশেপাশে চরতে ভালবাসে।

কমলা দামা দের ঠোট প্রায় দু সেমি.। ধারালাে ঠোট। তবুও না করে কারও সাথে ঝগড়া, না করে মারামারি। না পারতে ডাকাডাকিও করে না। তবে, খুব ভােরে আর সন্ধ্যার আগে মিষ্টি মােলায়েম স্বরে ডাকে অনেক সময়। কণ্ঠস্বর চিরি, চিরি, রিরি... ঝিরি...। শীতে তেমন ডাকে না। মােলায়েম শিস বাজাতে পারে। দোয়েল ও ফটিকজলের ডাক নকল করতে পারে। শীত-গ্রীষ্মে দু বেলা গােসল করে। বর্ষাকালে তাে গােসল লাগে না। আনন্দের সময় ডাকে কিরি কিরি... কিরি কিরি...।

কমলা দামা বাসা করে গাছের ঘন পাতাওয়ালা ডালের উপরে। গােলাকার বাসা। মজবুত। চামচের মতন হাতা থাকে। ওই হাতা ওরা জুড়ে দেয় ডালের সঙ্গে। বাসা বাঁধার আগে পুরুষ-পাখির আনন্দ যায় বেড়ে। গান গায় গলা খুলে। তবে, গােপন জায়গায় বসে। কী মধুর গান যে সে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। গান গাইবার সময় সে এমনিতেই গােপন জায়গায় বসে। সে গলা খুলে গায় তখন, যখন বৃষ্টি হবার পর ঝকঝকে রােদ ওঠে। বাসা করে ফাল্গুন থেকে আষাঢ় পর্যন্ত। বাসা হয় দুই স্তর বিশিষ্ট।

বাসা বাধার জায়গা খুঁজতে দু’জনে একসঙ্গে বেরােয়। ২/১ দিন লাগে। তারপর শুরু হয় বাসা বাঁধা। দু'জনে মিলে ৩-৫ দিনে বাসা শেষ করে। তারপর স্ত্রী চারটি ডিম পাড়ে। ১৪ দিনে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চারা উড়তে শেখে। ১০ দিন বাদে। কিন্তু তার আগেই বাসা থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামে। মা-বাবার পেছনে পেছনে লাফায়। ডানা কাপিয়ে খাবার জন্য বায়না করে। এসময় বেজি, গুইসাপ ও বনবিড়ালের খপ্পরে পড়ে ২/১টা বাচ্চা মারাও পড়ে। বাচ্চারা হয় খুবই ভদ্র ও শান্ত।

কমলা দামা দের প্রতিটি ডিমের ওজন হয় কয়েক গ্রাম মাত্র। লম্বায় সােয়া দুই সেমি। গােলাপি রঙ। তাতে নীলচে ও ফিকে আভা। সামান্য ছিটছােপ। চকচকে ডিম। ডিমে তা দেবার সময় সামান্য শব্দেও বাসা ছেড়ে উড়ে যায়—এতই ভীরু, আবার ফিরে আসে।

কমলা দামা দের খাদ্য তালিকায় আছে বিভিন্ন রকম কীটপতঙ্গ, পােকামাকড় ও কেঁচো। মাটিতে ঝরে পড়া তাল-খেজুরের রসও খায়। জল পান করে দিনের শুরুতে, দুপুরে আর সন্ধ্যার আগে। অল্প খেয়েই তুষ্ট থাকে ওরা। খুবই শান্তিপ্রিয় পাখি। কমলা দামা নামটি আলােকচিত্রী শিহাব উদ্দিনের দেয়া।

বাচ্চারা মা-বাবার সঙ্গে থাকে ১৫-২০ দিন। তারপর আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হবার পরও বাচ্চারা কিছুদিন একসাথে থাকে। এসময় ওরা মাঝে-মধ্যে চাদনি রাতে গান গায়। -বাবার সঙ্গে যখন থাকে, তখন রাত কাটায় মাবাবার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মাঝে মাঝে মজার কাণ্ড ঘটায় বাচ্চারা। মা-বাবার পেছনে পেছনে হয়তাে লাফিয়ে নামল কোনাে গভীর ডােবায়। ডােবার তলায় আছে পােকামাকড়। কিন্তু উড়তে না শেখায় ওই ডােবা থেকে আর উঠতে পারে না বাচ্চারা। খাড়া পাড় বেয়ে হেঁটেও উঠতে পারে না। কী আর করা। উড়তে না শেখা পর্যন্ত ওখানেই থেকে যায়। মা-বাবা ওখানে নেমেই খাবার খাওয়ায়। তবে, শিকারি প্রাণীদের নজরে পড়লে ওরা আর বাঁচতে পারে না। | কমলা দামা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলােতে বেশি আছে। এমন কোনাে গ্রাম নেই, যেখানে দু’ চার জোড়া কমলা দামা নেই। ওরা বাড়ির আঙিনায় আসে। সুযােগ পেলে ঘরেও ঢােকে। সুন্দরবনে আছে। খাদ্যাভাব নেই। বাসা বাঁধার জায়গার অভাব নেই। আবাসভূমি ঠিকই আছে। বাসা বাধার জন্য বেশি পছন্দ সুপারি পাতার ওপরটা।

কমলা দামা উপকারী পাখি। গায়ক পাখি। ক্ষতিকর পােকামাকড় খেয়ে সে যেমন পরিবেশকে সুন্দর রাখে, প্রকৃতির উপকার করে, তেমনি গান শুনিয়ে সে মানুষকে আনন্দ দেয়। দেখা দিয়ে মানুষের চোখ জুড়িয়ে দেয়। ওরা হাতের নাগালে ঘােরে। সবারই উচিত ওদের প্রতি ঢিল বা গুলতি না ছােড়া। কেননা, ওদেরকে মেরে তাে লাভ নেই কিছু। বাচিয়ে রাখলে সব দিক দিয়েই লাভ।

কমলা দামা ভাল রসিকতা জানে। অন্য পাখির বাসার আশেপাশে বসে সেই পাখির ডাক গলায় তােলে। বিভ্রান্ত সেই পাখিটি এসে দেখে, ওমা! এ দেখি কমলা দামা। কমলা দামা কে সব পাখিই ভালবাসে খুব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url