বাংলাদেশের পাখি : টিয়া
বাংলা নাম গােলাপিকষ্ঠি টিয়া বা টিয়া। ইংরেজি নাম Rose Ringed Parakeet. বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula kraineri মাপ ৪২ সেন্টিমিটার। |
হেমন্তের হিম হিম হাওয়া বইছিল। আমলকির ছায়ায় বসে থাকতে থাকতে ছেলেটির চোখে তাই বুঝি ঘুম নেমেছিল। বয়স ওর দশ বছর। আমলকি গাছে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। পরনে লুঙ্গি। পায়ের কাছে রাখা গুলতি ও মাটির তৈরি শক্ত ‘গুরােল।
গুলতি হাতে ও এসেছিল ধানক্ষেত পাহারা দিতে । বিশাল ধানের মাঠে কেবল সােনারঙ লাগতে শুরু করেছে। রােপা-আমনের মাঠ। এই মাঠেরই একথও জমি বর্গা করে ছেলেটির বাবা। ওই জমিটারই ধান আগাম পেকেছে, দু'একদিনের ভেতরই ধান কাটার মতাে হবে। কিন্তু ঝাঁক বেঁধে ক্ষেতে নামতে শুরু করেছে সবুজরঙা পাখি। পাকা ধানের শীষ কেটে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের দিকে।
যেভাবে আসছে পাখিগুলাে, তাতে দু’বিঘার এই ধানক্ষেতের সবগুলাে শীষ ওরা কেটে নিয়ে যাবে ১০/১২ দিনের ভেতর। তাহলে বর্গাচাষির মাথায় হাত। ধানক্ষেত উজাড় হলে বকুনি খেতে হবে ক্ষেতমালিকের, নিজেরও উপােষ দেবার দশা হবে।
চাষি তাই ছেলেকে পাঠিয়েছে ক্ষেত পাহারা দিতে। কিন্তু ছেলেটা বসে আছে তাে বসেই আছে, পাখিগুলাের দেখা নেই । চারপাশে ধানের মাঠ। মাঝখানে এক চিলতে উঁচু জমি। ঝােপঝাড়। দু'চারটে তাল-খেজুর গাছ। একটা আমলকি গাছ। ওর পাশেই বর্গাজমি। গুলতিতে ছেলেটির হাতের টিপ ভালাে। পাখিগুলো এলে আজ দেখে নেবে সে।
আকাশে সবুজ রঙের ছবি এঁকে, হেমন্তের মিঠে রােদে ঝলকাতে ঝলকাতে প্রায় ৩০০টি পাখি এল দক্ষিণ দিক থেকে। খুশিতে ডাকছে। 'ডাকতে ডকিতেই নেমে পড়ল ধানক্ষেতে। ধানগাছে তেরছা হয়ে বসে বাছতে লাগল পাকা পাকা শীষগুলাে। ধারালাে ঠোট দিয়ে কুট করে শীষ কেটে উড়ে যাবে আবার।
সবুজ পাখিদের ঠোটে সােনালি ধানের শীষ, উড়ছে সারি সারি চমৎকার দৃশ্যই বটে। কিন্তু পাখিদের চিৎকারে টুটে গেল ছেলেটির ঘুম। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে গুলতি হাতে। ক্ষেতে পাখিদের ঝুঁক দেখে সে ছুটল ওদিকে। পিচ্চি বালককে পাখিগুলাে যেন পাত্তাই দিল।
ক্ষেতে নেমে সে চেচাতে লাগল, হাততালি দিতে লাগল। কিসের কী! পাখিগুলাে ওড়াউড়ি করে এদিক-সেদিকে গিয়ে বসছে আবার। সমস্বরে চেঁচিয়ে ছেলেটিকে যেন শাসাচ্ছে। গুলতিতে ‘গুরােল জুড়ে একটি পাখিকে নিশানা করল সে।
গুরােল ছুটে গিয়ে আঘাত করল পাখিটির ডানপাশের ডানায়। মরণ চিৎকার দিয়ে পাখিটি পড়ল ধানক্ষেতের তলায়, ডানা ঝাপটাতে লাগল প্রচণ্ড রকম। ছেলেটি ছুটল ওকে ধরতে। যেই না ধরে তুলেছে ওকে ধারালাে ঠোটে ওটা গেঁথে ফেলল। ছেলেটির একটা আঙুল।
তখনি অভাবিতভাবে, চরম দুঃসাহসিকতায় ১০/১২টি পাখি চেঁচাতে চেঁচাতে এসে আক্রমণ করল ছেলেটিকে। একে তাে আঙুলে মরণ কামড়, তার ওপর পাখিদের আক্রমণ। নথ ঠোটে আহত করতে চাইল ছেলেটিকে। ফাকা মাঠে পাখিদের এ রকম আক্রমণের কথা তার কল্পনাতেও ছিল না।
সে জানত না, যাকে সে গুলতি দিয়ে পড়ে ফেলেছে, সেটার বয়স মাত্র ৪ মাস। গত আষাঢ়ে ওটার জন্ম। বাচ্চাই । বাচ্চার জন্যই পাখিগুলাে ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ করেছে। খােলা মাঠে পিচ্চি একটি মানুষকে ওরা ভয় পাবে কেন!
প্রায় বুক সমান ধানক্ষেত ঠেলে ছেলেটি দৌড়তে পারল না বেশিক্ষণ। ধানবনে পড়ে গেল পা হড়কে। পাখির বাচ্চাটি কিন্তু কামড় ছাড়ে নি- ঝুলে আছে ছেলেটির আঙুলে। মাটিতে পড়ার পর ছেলেটি বুঝে ফেলল আসল। ঘটনা। হ্যাচকা টানে পাখিটিকে আঙুল থেকে ছাড়িয়ে ছুড়ে দিল শূন্যে, আহত পাখির বাচ্চা কিছুটা উড়তে পারল, তারপরে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে ।
পাখিদের ঝাক তখন সরে গেল ছেলেটির মাথার ওপর থেকে। ঘুরতে লাগল সেখানে। ছেলেটির কান, চিবুক, পিঠ ও ঘাড়- সব জায়গায় পাখিগুলাে হয় নখর চালিয়েছে, না হয় ঠোট লাগিয়েছে। ছেলেটি কাপছে থরথর করে ।
এই পাখিদের ঠোটের ধার সে জানে। দেখেছে বাসা-ডিম-বাচ্চা। অন্য পাখিদের হটিয়ে দিয়ে বাসা দখল করতেও সে দেখেছে- দেখেছে বেজি, বনবিড়াল ও পেঁচাদের ধাওয়া করতে। কিন্তু এ রকম দলবদ্ধ আক্রমণ যে মানুষকে করতে পারে, তা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।
অবশ্য বাসায় উঠে ডিম-বাচ্চা চুরি করতে গেলে মানুষকে আক্রমণ করে। ছেলেটি নিজেও সে আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু আজকের ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত। | ছেলেটির বাড়ির মরা নারকেল গাছের খোড়লে একবার বাসা করেছিল এক জোড়া পাখি । বাচ্চা হল।
বাচ্চারা একটু বড়ও হল। তখন একটা কুকো পাখি ওই খোড়লে মাথা ঢুকিয়েছিল বাচ্চাদের ধরতে । অমনি একটি বাচ্চা ধারালাে ঠোটে চেপে ধরেছিল কুকোর চোখের নিচের নরম চামড়া। কুকোর তাে তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' দশা। কুব, কুব,' চিৎকারে সে পড়েছিল মাটিতে। মাথা ঝাকিয়ে, ঠোট বাঁকিয়ে ও পা চালিয়েও নিস্তার পায় নি সেদিন।
কেবল পালক গজানাে পাখির বাচ্চাটি সেদিন কামড় ছাড়ে নি মরার আগ পর্যন্ত- যেমন আজ এই ছেলেটির আঙুলও ছাড়তে চাইছিল না । | দুঃসাহসী ও ধারালাে ঠোটের এই পাখিটির নাম টিয়া বা গোলাপিকণ্ঠি টিয়া (Roseringed Parakeet)। বাংলাদেশে আরাে ৪/৫ রকম টিয়া আছে। স্বভাব-চরিত্র, খাদ্য, বাসা-বাঁধার জায়গা ও ডিম-বাচ্চার ক্ষেত্রে সবাই একই রকম। তবে গোলাপিকণ্ঠির মতো সাহসী টিয়া বাংলাদেশে আর নেই।
এবার অতি সংক্ষেপে বাংলাদেশের টিয়াদের পরিচয় জেনে নেওয়া যাক।
১. গােলাপিকষ্ঠি টিয়া বা টিয়া (Roseringed Parakeet); বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula krarieri মাপ ৪২ সেন্টিমিটার। গলায় গােলাপি-কালাে বলয়। আলতরঙা ঠোট। মেয়েপাখির গলায় কষ্টি নেই। সবুজ ঘাসের মতাে শরীরের রঙ। ঢাকা শহরে প্রচুর পরিমাণ আছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই দেখা যায়।
২, বড় টিয়া বা চন্দনা (Alexandrine Parakeet) : মাপ ৫৩ সেন্টিমিটার। দেখতে সবুজরঙা। গলায় কালচে রঙের অর্ধবলয় আছে। ঠোট লাল। বন পছন্দ করে। মেয়েটির গলায় অর্ধবলয় থাকে না।
৩, লালমাথা টিয়া (Blossomheaded Parakeet); মাপ ৩৬ সেন্টিমিটার। পুরুষের মাথা লাল-নীল। মেরুন রঙের ঘাড়-মাথা কপাল। মেয়েটির মাথা-ধূসর ছাই, গলায় থাকে চকচকে হলুদ বলয় । | ৪, মদনা বা লালবুক টিয়া (Redbreasted Parakeet) ; মাপ ৩৮ সেন্টিমিটার। বুক-পেট লালচে। তাতে গােলাপি হালকা আভা। ঠোটের ওপর দিয়ে দু'চোখ পর্যন্ত হালকা টান আছে। ঘাড়-গলা জুড়ে চওড়া হলুদ টান আছে।
৫. লটকন (Vernal Hanging parrot) : মাপ ১৪ সেন্টিমিটার। দূর থেকে মনে হবে লাভবার্ড। পাহাড়ি বনে বাস করে। সবুজ পাখি। ঠোট ও লেজের তলা লাল। হলুদ পা। লেজ যেন নেই! রাতে গাছের সরু ডালে পা। আঁকড়ে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিব্যি ঘুমাতে পারে।
এরা সবাই দু'পা ও ঠোটকে হাতের মতাে ব্যবহার করতে এবং গাছের ডালে উল্টো হয়ে ঝুলতে পারে। সবার গলায় ভালাে জোর আছে। মিষ্টি গল। উড়তে পারে দ্রুত। আচমকা বাঁক নিতে পারে। উল্টো হয়ে ঝুলে। বুলে বাদুড়ের মতাে এক ডাল থেকে অন্য ডালে চলাফেরা করে।
টিয়া বলতে আমরা গােলাপি কষ্ঠিকেই বুঝি। তাই এই টিয়া সম্পর্কে অতিসংক্ষেপে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
দলে থাকে। গাছের খোড়ল বা দরদালানের ফাঁকফোকরে বাসা করে । জায়গা বাছাই করে ২/৩ দিনে। মাঘ-জ্যৈষ্ঠে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৪. ৬টা। গােল ধরনের, রঙ সাদা। মেয়েটি একা ডিমে তা দেয়। ২৩-২৭ দিনে বাচ্চা ফোটে। ৫২-৫৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে পারে। টিয়াদের খাতালিকায় আছে ধান, গম ও ফল।
টিয়া পােষ মানে। কিছু বুলি আওড়াতে পারে। দ্রুত উড়ে গিয়ে বসার ঠিক আগ মুহূর্তে খাঁজকাটা (লেজের পালকের বিন্যাসের জন্য ও রকম মনে হয়) লেজটা পাখার মতাে মেলে দেয়। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। খাঁচাবন্দি টিয়া বুনাে টিয়াদের ডাক শুনলে সাড়া দেয়, ছটফট করে। পাখা মেলতে চায়। ঢাকা শহরে প্রচুর পোষা টিয়া আছে। |
বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিশু একাডেমী এলাকায় বড় বড় গাছগুলােতে সন্ধ্যার সময় টিয়ারা দল বেঁধে আশ্রয় নেয়। ওই সব গাছে ভুবনচিলেদেরও বাস। টিয়ারা যে গাছে আশ্রয় নেয়, সে গাছে ভুবনচিলকে বসতে দেয় না। এমন কি ভুবনচিল আগেই আশ্রয় নিয়েছে সেই গাছে টিয়ারা এসে ভুবনচিলেদের হটিয়ে দেয়। ভুবনচিল কি আর সহজে যেতে চায় আশ্রয় ছেড়ে! সে এক মজার কাণ্ডই বটে!
উপকারী ও সুন্দর এই পাখিটিকে আজো পরম যত্নে বুকে আগলে রেখেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি। মানুষ না জানুক প্রকৃতি জানে, টিয়া তার জন্য কতটা দরকারি পাখি । তাই তাে টিয়া আছে গ্রাম ও শহরে। আছে সুন্দরবনে। সবুজ টিয়ারা টিকে থাক এই সোনার বাংলাদেশে। আরেক প্রজাতির টিয়াও আছে সিলেট-চট্টগ্রামে। নাম ধূসরমাথা টিয়া। ইংরেজি নাম Grey-headed parakeit.