বাংলাদেশের পাখি : সাগর ঈগল

বাংলাদেশের পাখি : সাগর ঈগল
বাংলাদেশের পাখি : সাগর ঈগল

কটকা নদীর মােহনার ওপরে পাক খাচ্ছে এক জোড়া বুক-পেট সাদা পাখি। অক্টোবরের ইস্পাতনীল আকাশের পটভূমিতে ওদেরকে খুব সুন্দর লাগছে। উড়ছে ওরা বৃত্তাকারে, ঘুরে ঘুরে। ধীর লয়ে। কটকা সী-বীচে সাগরের ঢেউগুলাে আছড়ে পড়ছে বারবার। এক দল হরিণ চরছে ওই সী-বীচের কাছাকাছি। সাগরের শব্দ, বাতাস আর সুন্দরবনের গাছপালার শব্দ ছাড়া অন্য কোনাে শব্দ নেই আশেপাশে।

পাখি দুটির যেন কোনাে তাড়াহুড়াে নেই—ঘুরে ঘুরে উড়ে ওরা ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে ক্রমশ। বারবার ওদের ঘাড়-মাথা ঘুরছে এদিকেওদিকে-ওরা শিকার খুঁজছে। হতে পারে সেটা সামুদ্রিক সাপ, পড়েছে সুন্দরবন ও নদী-সাগরের কিনারে। ওদের ভেতর দুর্বল বা কাহিল কাউকে পেলেও চলবে। এসব না জুটলে খুঁজতে হবে মদনটাক পাখির বাসা। ওদের বাসায় এখন ছানা আছে।

কৌশলে দু'একটাকে তুলে আনতে পারলে আজকের দিনটা চলে যাবে। কিন্তু মদনটাকের যে ঠোট! ওই ঠোট ফাঁক করে ওরা যখন ভয় দেখায়, ঠোটে ঠোটে টক্কর দিয়ে ঠোট তালি’ বাজায়, তখন ভয় পেতেই হয়।

পাখি দুটি উড়ছে। ঘুরছে ওদের চোখ। দৃষ্টি খুব প্রখর। কোনাে শিকারই নজর এড়াবে না। ওরা পাখা নাড়ছে কম। মনে হচ্ছে, বাতাসে ডানা মেলে ভেসে ওরা সুখ পাচ্ছে খুব। বাতাস বইছে কিছুটা উত্তরে। বাতাসের গতিবেগ ওরা যেমন খুব ভালাে বােঝে, তেমনি বাতাসকে ব্যবহার করে কীভাবে বেশিক্ষণ ডানা না নেড়ে ভেসে থাকা যায়, তাও জানে খুব ভালােভাবে।

আজ ভােরে উঠে ওরা দু' জনে গতকালকের শুরু করা বাসাটার ভিত্তি করে ফেলেছে। বাসা বাঁধা শুরু করার আগে দুজনে মিলে বাসা করার যুৎসই গাছ নির্বাচনে বেরিয়েছিল। তিনদিন ঘুরে ঘুরে কটকা নদীর পূর্ব পাড়ের একটা বড়সড় কেওড়াগাছ পছন্দ হয়।

সঙ্গে সঙ্গে দু'জনে মিলে বাসার কাজ শুরু করেছিল। সুন্দরী, গেওয়া ও কেওড়া গাছসহ অন্যান্য গাছের সরু ডাল (শুকনাে ডাল, কাচা ডাল পাতাসহ) ধারাল ঠোটে কেটেটেনে ছিড়ে এনে বাসার ভিত্তিটা শুরু করেছিল গতকাল।

ওইসব ডাল-পাতা ঠোটে-পায়ে ধরে উড়ে আসাও তাে চাট্টিখানি কথা নয়! বেকায়দা হলে অনেক ডাল (যা কষ্ট করে টেনে ভাঙা হয়েছে) ঠোট থেকে খসিয়ে দিতে হয়! আবারাে যেতে হয় নতুন ডালের সন্ধানে। দু'জনে মিলে গতকাল ডালপাতা ঠিকঠাক মতাে সেট করেছে অনেক কষ্টে। কেওড়া গাছের মগডালে সুন্দরভাবে সেট করতে হয়েছে ডালপালা ।

শক্তভাবে না হলে তাে অল্প-ক; বাতাসে বাসা খসে যাবে, পড়ে যাবে নিচে। গত বছর ওরা বাসা করেছিল মস্তবড় একটা সুন্দরী গাছের মাথায়। ডিম-বাচ্চা তােলার পরও বাসাটা ঠিকঠাক মতন ছিল। ওই বাসাটা সিডরে উড়ে না গেলে এক বছর আর এত কষ্ট করা লাগত না। সময়ও নষ্ট হত না।

পুরনাে বাসা একটু ঠিকটাক যেমন করে নেওয়া যায়, তেমনি নতুন কিছু ডাল-পাতা এনে আরাে আরামদায়ক করা যায়। অবশ্য, ওই সুন্দরী গাছটাতে এবারও বাসা করা যেত—তিন দিন ব্যয় করে নতুন জায়গা খুঁজতে হত না হন্যে হয়ে, কিন্তু এবার ওখানে বাসা করেছে এক জোড়া শামুকভাঙ্গা পাখি। কী আর করা!

তিন দিন খুঁজে তারপরেই নতুন বাসা বাঁধার কাজ শুরু হয়েছিল। আজ সকালে বাসার ভিত্তিটা দু'জনে মিলে গড়ে ফেলেছে। তারপর পেটের খিদেয় পাখা মেলেছে কটকা নদীর মােহনার ওপরে। উড়ছে তাে উড়ছেই। শিকার পড়ছে না নজরে। সারা সকাল যে খাটুনি গেছে দু’জনের, তাতে পেটে কিছু না পড়লে তাে বিকেলে আর বাসার কাজটা করাই যাবে না।

বাংলাদেশের পাখি : সাগর ঈগল
সুন্দর এই শিকারি পাখিটির নাম সাদা ঈগল বা সাগর ঈগল। ইংরেজি নাম White bellied sea eagle af at Haliacetus Leucogaster পুরুষ পাখিটির মাপ ৭১ সেন্টিমিটার মেয়েটির মাপ ৭৮ সেন্টিমিটার।

একটি কোড়াল মাছের পিঠ ভাসল মােহনা থেকে আনুমানিক দুশাে গজ দূরে, বঙ্গোপসাগরের ভেতরে। দু'জনেরই নজর পড়ল। দুজনেই পাখা কিছুটা মুড়ে ডাইভের ভঙ্গিতে নামতে শুরু করল। মেয়ে পাখিটি মাঝপথে নেমে তার গতি কমাল-দু’জনে এক সাথে ডাইভ মারা তাে চলবে না। 

পুরুষটি আনুভূমিক ২৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে নামতে লাগল দ্রুত বেগে, সাগরের বুক থেকে আনুমানিক ২৫ গজ ওপরে এসেই সাঁ করে একটা চক্কর দিল, তারপর বােমারু বিমানের মতাে চলল শিকারের দিকে। এখানে লক্ষণীয় যে, ২৫ গজ ওপরের ওই যে চক্করটা, তা না দিলেও চলত। দিতে হল তার কারণ—পাখিটি চাইছিল তার শরীরের ছায়া যেন শিকারের ওপরে না পড়ে। ছায়া পড়লেই শিকার টুপ করে ডুব দেবে। সূর্যের বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে এসে তাই হিট করতে চায় টার্গেটে।

জলের অল্প ওপরে এসেই পাখিটি বিমানের চাকার কায়দায় খুলে দিল পা ও নখর, জলের সমান্তরালে উড়ে-নখর বসাল শিকারের পিঠে। জলে শব্দ উঠল, মস্তবড় কোড়াল মাছটি জলে ঝাপটানি তুলে ডুব দিল। কিন্তু পাখিটি-বড়সড় সুন্দর সাদা শিকারি পাখিটি পা দু'খানা টেনে রাখল শক্ত করে, প্রশস্ত দু'ডানা মেলে ধরে বারবার ঝাপটে নিজের ও শিকারের ভারসাম্য রক্ষা করতে লাগল। কিন্তু মাছটি বড়, পাখিটির চেয়ে তার শক্তিও বেশি—পাখিটিরও সাধ্য নেই অত ওজনের মাছটিকে নিয়ে সে উড়বে, পৌছে যাবে উপকূলে। 

এ রকম বােকামি এই পাখিরা মাঝে-মধ্যেই করে থাকে—সাধ্যে কুলাবে না জেনেও শিকারের শরীরে নখর বসায়। এখন এটা। যদি সাগর না হত, পাড় না থাকত অনেক দূরে, তাহলে শক্তিতে না হােক, কৌশলে পাখিটি শিকারকে নিয়ে তুলতে পারত পাড়ে। 

তারপর ঠুকরে মাছটিকে মেরে মাটিতে বসেই মজাছে খেতে পারত। গ্রাম এলাকার পুকুরদিঘি, হাওর-বাওড় বা বিল-ঝিলে ওরা এভাবে বড় শিকার ধরে-জলের ওপর দিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শিকারকে টেনে নিয়ে পাড়ে তােলে। নখরও বটে এদের! মােটা সুতার (পায়ের আঙুল) মাথায় যেন চারটে ধারাল মােটাসােটা বড়শি (নখর) ওতে গাঁথলে আর ছাড়া পাবার উপায় থাকে না।

এ রকম দৃশ্য আমি কমপক্ষে ১৭ বার দেখেছি, কমপক্ষে ৫ বার দেখছি পাখিটির মৃত্যু ঘটতে—মাছ পাখিটিকে নিয়ে জলের তলায় ডুব দিয়েছে। খেপজাল মেরে ওই মৃত পাখি ও মাছকে পাড়ে তােলা হয়েছে। একবার দেখেছি (২৭ ঘণ্টা পরে) মৃত পাখি ও মাছকে একসঙ্গে মরে জলের ওপরে ভেসে উঠতে। এ রকম ক্ষেত্রে পাখি ও মাছের লড়াইটা হয় দেখার মতাে। মাছ চায় ডুব দিয়ে গভীরে যেতে। পাখি চায় মাছকে টেনে উপরে রাখতে। 

দু' পাখা দিয়ে পাখি যেন সাতরায় আসতে চায় পাড়ের দিকে। পাড়ে এসে সে ডানা ঝাপটিয়ে ওপরে ওঠে। প্রথমেই ঠুকরে নষ্ট করে দেয় মাছের চোখ। তারপর ঠোট চালায় মাছের পেটে। নখর যেখানে বসে, সেখান থেকে মাছের রক্ত গড়ায় কলকল বেগে-ঠোট যেখানে চালায়, রক্ত গড়ায় সেখান থেকেও। ঠোটও বটে এদের! বড়শির মতাে বাঁকা, দারুণ শক্ত। মানুষের। 

পায়ের চামড়াও ফুটো করে দিতে পারে অনায়াসে। কিশােরবেলায় বিশেষ। করে গরমকালের দুপুরে পুকুর-দিঘি বা কম জলের বিল-ঝিলের পাড়ে ওঁৎ পেতে থেকে এই পাখিদের শিকারকৌশল আমি যেমন দেখেছি, তেমনি পাড়ে টেনে তােলা মাছ আমি ছিনতাইও করেছি। পাড়ে মাছ টেনে তােলার পরে দৌড়াতে গেলেই ওরা তাড়াতাড়ি শিকার থেকে নখর খসাতে হিমশিম খায় । ওরকম ক্ষেত্রে ওদের বােধহয় ধরে ফেলাও সম্ভব। কিন্তু মানুষের তাে ।

লক্ষ থাকে মাছ, পাখি নয়। নখর খসিয়ে পাখিটি পালানাের পরে আহতরক্তাক্ত মাছটিকে ধরতে গেছি যতবার, ততবারই মাছের তাজা রক্তে রক্তাক্ত হয়েছি আমি। সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলাে তাে বটেই, বন থেকে ৭০/৮০ কিলােমিটার এলাকার মধ্যে আজো গরম ও শীতকালে কম হলেও দেখা যায় এদের। শীতে আসে কম জলের মাছ শিকারের আশায় । 

গরমে আসে রােদে গরম হওয়া জলে খাবি খাওয়া মাছ ধরতে । ভাদ্রের প্রচণ্ড গরমেও যখন মাঠ-বিলের মাছেরা খাবি খায়, তখনাে দেখা মেলে এদের। কিন্তু অনিবার্য কারণেই এদের সংখ্যা গেছে অনেক কমে। সুন্দরবনই এখন ওদের ঠিকানা। চট্টগ্রামের উপকূলেও দু'পাচটা দেখা যায়। এই যে কমে যাওয়া, এর পেছনের অনেকগুলাে কারণের মধ্যে একটি মুখ্য কারণের কথা আমি বলছি এখন। হাঁস-মুরগির ছানার ওপরে এদের দারুণ লেভি। 

লেভিটা আরাে বেড়ে যায় ওদের বাসায় ডিম-বাচ্চা হবার পর। এ রকমও আমি দেখেছি যে, একদিনে একটি মুরগি বা একটা হাঁসের (হাঁসের বাচ্চাও প্রায় ক্ষেত্রে লালন-পালন করে মুরগিতে, মুরগির পেটের তলায় হাঁসের ডিম ফুটানাে হয়। হাঁসের ছানারা জলে চরে, মুরগি মা জলের চারপাশের মাটিতে হেঁটে বাচ্চাদের নিরাপত্তা বিধান করে। 

সেও এক মজার দৃশ্য) ১২/১৩টি ছানাকে শিকার করেছে এই পাখিরা মায়ের কোল একেবারে খালি করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বন্দুকের গুলিতে মারা পড়ে এরা। বাসা থাকলে বাচ্চাসহ বাসা নামানাে হয়, বাচ্চাদের মেরে ফেলা হয়। বন্দুক দিয়ে শিকার করতে গিয়ে। দেখেছি, এরা খুবই চতুর পাখি। বন-বাগানের ভেতর দিয়ে উড়ে পালাতে পারে দ্রুত। 

পাখাটা লম্বা করে বন্দুক শিকারিকে দেখে। আমার এলাকায়। (বাগেরহাট) ভাদ্র ও গরমে আজো দু'পাঁচটা পাখি আসে, কৃচিৎ বাসাও করে। কিন্তু বাচ্চা নিয়ে যেতে পারে না। ওরা সুন্দরবন থেকে আসে, থাকতে চায় স্থায়ীভাবে, পারে না। অথচ মাত্র ২৫/৩০ বছর আগেও ওরা গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট ছিল, বাসাও করত। এখন গ্রাম এলাকায় ওদের খাদ্য নেই বলতে গেলে, হাঁস-মুরগির দিকে হাত (ঠোট) বাড়ালেই মৃত্যু অবিবার্য হয়ে ওঠে। তাই ওরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।

এখন কটকা নদীর মােহনায় যে পাখিটি নখরে গেঁথেছে মস্তবড় কোড়াল মাছটিকে, সে পড়ে গেছে বিপদে। শিকার কী ছেড়ে দেওয়া যায় সহজে। শিকার নিয়ে উড়তে পারলে বা পাড়ে পৌছুতে পারলে সঙ্গী-পাখিকে নিয়ে খাওয়া যেত মজা করে। তারপর আবারাে শুরু করা যেত বাসার কাজ। সঙ্গিনী পাখিটি এখন তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে, ঘুরছে, ডাকছে ভাবছে—পুরুষপাখিকে সাহায্য করা যায় কিনা! কিন্তু শিকারের ক্ষেত্রে এসে অপরকে সাহায্য করতে এরা পারদর্শী নয়।

মাছটির সঙ্গে ঝাড়া পাঁচ মিনিট লড়াই করে পুরুষ পাখিটি যখন বুঝল যে, আর কিছুক্ষণ চললে মাছটি তাকে নিয়ে ডুব দেবে, তখন সে কৌশলে নখর খসাল। ব্যর্থতার ডাক ছেড়ে উঠে পড়ল ওপরে, ডানা ও শরীরে বার কয়েক ঝাকুনি দিয়ে জল ঝেড়ে আরাে ওপরে উঠল। 

তারপর দুজনে মিলে আবারাে শুরু করল পাক খাওয়া। আবারাে শিকারের সন্ধান। কটকা নদীর পশ্চিম পাড়ের সাভানা (ঘাসভুমি) অঞ্চলে চরছে এক পাল হরিণ ; দক্ষিণ দিকের ছােট খালটা পেরিয়ে উঠে এল ৫/৭টি শুয়াের। ওদের
সঙ্গে একেবারে কম বয়সী ছানা প্রায় দু'ডজন। শুয়ােরগুলাে সাভানা পাড়ি দিয়ে চলল উত্তর দিকে ।

শুয়ােরকে সুন্দরবনের হরিণেরা ভয় পায় না। মােহনার ওপর থেকে পাখি দু'টি দেখল শুয়ােরদের। ধেয়ে আসতে শুরু করল সাভানার দিকে। নিচে থেকে ওদের বুক-পেট ও ডানার তলাটা দেখাচ্ছে ধবধবে সাদা। ডানার প্রান্তের পালকগুলাের তলা ধাতবকালে। 

লেজটা গোলাকার ধরনের- ধেয়ে আসার সময় সেটা যেন আরো গোলাকার হয়। লেজের তলাও সাদা। এখন মনে হচ্ছে সাদা-কালাে একটি পাখি যেন বিমানের মতাে ধেয়ে আসছে সাভানার দিকে। ওর পেছনে আসছে অন্যটি। মাটি থেকে হাত তিরিশেক ওপরে আসতেই হরিণগুলাে ‘টাই টাই' করে চিৎকার জুড়ে দিল, শুয়ােরগুলােও ঘোং ঘোঁৎ করে উঠল। 

সামনের পাখিটা ডাইভ মেরে একেবারে পিচ্চি একটি শুয়াের-হানার কোমরে দু'পায়ের নখর গেথে পাখিটি সেই অ্যাঙ্গেলেই ওপরের দিকে উঠে গেল, যে অ্যাঙ্গেলে সে ডাইভ মেরেছিল। ডাইভ মারা ও উঠে যাবার পথটিকে যদি সরলরেখা কল্পনা করা যায়, তাহলে সেটা হবে ইংরেজি 'ভি' (v) অক্ষরের মতাে। হরিণের ছানাগুলাে দৌড় লাগাল। বােকা শুয়ােরগুলাে দৌড়াদৌড়ি করে শত্রুকে খুঁজতে লাগল আকাশে। এখন শুয়াের-ছানার করুণ কান্না। 

পেছনের পাখিটি ডাইভ মারে নি। দুটি পাখি পাশাপাশি উড়ে চলেছে কটকা নদী পাড়ি দিয়ে, পূর্ব দিকে। ওদিকেই থাকে ওরা। বাসাও করছে ওদিকে। ওদিকেরই কোনাে গাছে বসে প্রথমে ঠুকরে ঠুকরে মারবে শিকারকে। তারপর খাবে। সুন্দরবন থেকে এই পাখিরা পিচ্চি হরিণ-শাবকও তুলে নেয়। সুযােগ পেলে মেছােবাঘ-ভোঁদড়ের বাচ্চাও তুলে নেয়। গ্রামাঞ্চলে ওরা বিড়াল, বনবিড়াল, খাটাস ও শিয়ালের বাচ্চাও শিকার করে। 

অসুস্থ বড় হাঁস-মুরগিও তুলে নেয়--অসুস্থ বা আহত এইসব প্রাণীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গুদের রয়েছে এক আশ্চর্য ক্ষমতা। বন্যজম্বর এমন বাচ্চাও এরা শিকার করে থাকে, যা ওরা নখরে গেথে উড়তে পারে না। জায়গায় বসে খায়। ওদের ডানার ছায়া দেখলে হাঁস-মুরগিরদের প্রাণ উড়ে যায় ত্রাসে। ছােট ও মাঝারি পাখিরাও ভয়ে পালাতে চায়।

যদিও ধাওয়া করে এরা সাধারণত পাখি শিকার করে না । সুন্দর এই শিকারি পাখিটির নাম সাদা ঈগল বা সাগর ঈগল । ইংরেজি - White bellied sea eagle icons Haliacetus Leucogaster! পুরুষ পাখিটির মাপ ৭১ সেন্টিমিটার মেয়েটির মাপ ৭৮ সেন্টিমিটার। পুরুষ-মেয়ে দেখতে একই রকম। সাদা বুক-পেট, পালক ঢাকা পাড়, ঘাড়-গলা, কপােল ও মাথার চাঁদি এই পাখিটির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠোট খয়েরি লাল।

ডানা বুজানাে অবস্থায় পিঠ ও শরীরের উপরিভাগটা বাদামি-ধূসর, ছাই বর্ণের আভাও আছে। পা আর ঠোট ছাড়া বাকিটা চকচকে সাদা বলেই পাখিটির নাম সাদা ঈগল হয়েছে। সাগরের পাড়ে, নদীর মােহনায় থাকে বলে নাম সাগর ঈগল। 

কিন্তু বর্তমানেও গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, আগে স্থায়ীভাবে থাকতও গ্রামে। সুন্দরবনে এখন যারা বাসা করে, বাচ্চা হবার পরে হাঁস-মুরগির ছানার জন্য ৩০ কিমি পথ পাড়ি দেয় ওরা। ডিম-বাচ্চা না থাকলে এক জোড়া পাখিকে প্রায় সর্বক্ষণই পাশাপাশি দেখা যায়। এদের ওড়ার ভঙ্গি, ঘাড় লম্বা করে তাকানাে আর ডাইভ মারার কৌশলে সত্যিই রয়েছে এক রাজকীয় ভাব। চেহারায়ও আছে আভিজাত্যের ছাপ।

বছরে একবার ডিম বাচ্চা তােলে এরা। বর্ষা ঋতুটা বাদ দিয়ে যেকোনাে সময়ে ডিম পাড়তে পারে এরা। কোনো রকম অসুবিধা না হলে এরা প্রতিবছর একই বাসায় ডিম পাড়ে। প্রতিবারই বাসায় কিছু নতুন উপকরণ আনে। বাসা তাই হয়ে পড়ে বড়সড় মাচানের মতো। এরকম একটি বাসার ডালপালা দিয়ে একবেলার রান্নার কাজ সারতে পারবে যে-কোনাে গ্রাম্যবধূ। 

আমি সাগর ঈগলের বাসা দখল করতে দেখেছি শকুনদের। সাগর ঈগলেরা বাসা বাঁধার আগে থেকেই খুশিতে শূন্যে উঠে দুটিতে পাক খেয়ে ওড়ে, এ-ওকে ধাওয়া করে, এই নেমে আসে পাক খেতে খেতে, এই আবার উঠে পড়ে শূন্যে। ওদের ওই আনন্দ-ক্রীড়া দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না। দু' জনে মিলেই বাসা সাজায়। সময় লাগে (নতুন বাসা হলে) ৬-৯ দিন। 

তারপর ২৪ ঘণ্টার ভেতরে দুটি ডিম পাড়ে স্ত্রী ঈগল। দু’জনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ৩৬-৪২ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। বাচ্চাদের রঙ থাকে সাদা। বাচ্চা হবার পরে দুটি পাখি একসঙ্গে থাবার আনতে যায় না, যায় এক জনে। সে খাবার এনে বাসায় ফেলেই আবার বেরিয়ে পড়ে। বাসায় থাকা পাখিটি ওই খাবার কেটে কেটে বাচ্চাদের খাওয়ায়। ৭০-৭৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে পারে। তার পরেও ২১-২৮ দিন মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মা-বাবার শিকার করা দেখে, নিজেরা শেখে। 

দু’বছর বয়স হলে ওই বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের বাসা গড়ে, ডিম-বাচ্চা তােলে। সুন্দরবনের বাইরে যেসব গাছে বাসা করে ওরা, সেগুলাে হচ্ছে, তেঁতুল, শিমুল, রাজশিরীষ, বয়সী দেবদারু ও আমগাছ, বট-অশ্বথ, কাঠবাদাম গাছ । জলের কাছাকাছি বাসা বাঁধার প্রবণতা এদের রয়েছে। 

একজোড়া পাখি বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখে, এই এলাকায় অন্য সাগর ঈগল এলেই ধাওয়া করে। এ যেন অলিখিত রাজত্ব। স্বজাতিকে ধাওয়া করার সময় এরা গলায় ধাতব আওয়াজ তােলে দ্রুত তালে-কণ্ঠস্বর সুরেলা, তীক্ষ'। আবার বাসা বাঁধার আনন্দে, ডিম-বাচ্চা হবার আনন্দেও এরা ডাকাডাকি করে শূন্যে উড়তে উড়তে।

সুন্দর পাখি সাগর ঈগল বর্তমান বাংলাদেশে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। বিল-ঝিলে মাছ নেই। বাসা বাঁধার গাছ নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই ।

দেশের স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে একটি পাখিকে টিকিয়ে রাখা আজ বড়ই জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনাে পাখি যেন হারিয়ে না যায়। গত ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের রাতে সুন্দরবনের ২টি বাসার ৪টি সাগর ঈগলের বাচ্চা বাসা থেকে পড়ে আহত হয়েছিল। কয়েকজন জেলে ওদের সেবা করে সুস্থ করেছিল।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url