বাংলাদেশের পাখি : ধান টুনি

এই পুঁচকে চতুর পাখিটির বাংলা নাম ধানটুনি। ঘাস টুনিও বলা যেতে পারে। কেননা, উলুঘাস, খড়, কাশবন ও অন্যান্য জাতের ঘাসবনও এদের প্রিয় আবাস ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ইংরেজি নাম Zitting cisticola. বৈজ্ঞানিক নাম Cisticola Janacidis, শরীরের মাপ ৮-১২ সেন্টিমিটার।

ভাদ্র মাসের ভরদুপুর। একটি পাকা তাল পড়ল ধানক্ষেতে। জল ছিল অল্প, শব্দ উঠল প্রচণ্ড। ঘাবড়ে গিয়ে ক্ষেতের ভেতর থেকে ঝট করে উড়াল দিল তিনটি কানিবক, একটি রঙিলা চ্যাগা, একঝাক গােবরে শালিক ও একটি ডাহুক। সবশেষে ‘ঝিটঝিট' ডেকে পুঁচকে একটি পাখি উড়ল ছন্দে ছন্দে, দুলে দুলে অনেকটা ওপরেও উঠে গেল, দু'পাক ঘুরল ধানক্ষেতটার মাথায়, তারপর আবার ছন্দে ছন্দে নামতে শুরু করল নিচের দিকে, আর থেমে থেমে ডেকেই চলেছে। টুনটুনির মতাে ছােট পাখি, কিন্তু ওড়ার ভঙ্গি ভারি সুন্দর! কণ্ঠটা ধাতব, তীক্ষ ও সুরেলা। উড়ছে যেমন ছন্দে ছন্দে, তার সাথে তাল মিলিয়ে ঝিট ঝিট, ঝিট ঝিট শব্দে ডেকেও চলেছে। ইস্পাত-নীল আকাশের পটভূমিতে ওকে যেন দেখা যাচ্ছে না ভালাে করে।

তালগাছটার মাথার ওপর দিয়ে আসছে যখন, তখন তালগাছ ঘিরে উড়ন্ত পুঁচকে এক বাতাসি (পাম সুইফক্ট) পাখি তেড়ে এল ওর দিকে। ভয় পেল হয়তাে একটু, ঝিট ঝিট ডেকে সা করে শূন্যে উঠে গেল। তারপর চোখ জুড়ানাে ভঙ্গিতে বাঁক নিয়ে নামতে শুরু করল নিচের দিকে। ওটা একগুচ্ছ ধানগাছের ওপরে নামল বটে, সরাসরি না নেমে ঘুরপাক খেয়ে নামল। ধানের ডগায় ফেলার ঠিক আগমুহূর্তে লেজটা মেলে গেল মােহনীয়।

ভঙ্গিতে, যেন-বা তৈরি হয়ে গেল ছােট একখানা তালপাতার পাখা। চোখজুড়ানাে আর মন ভুলানাে দৃশ্য। ডাক থেমে গেছে। মাথাটা একটু টান করে তাকাল ধানগুচ্ছের গোড়ার দিকে। ওখানেই কলার মােচার গড়নের ছিমছাম বাসাটি, তাতে তুলতুলে ৪টি স্থানা। বয়স মাত্র দু'দিন। এই একটু আগেই সে ছানাদের বুকের ওমে রেখে বসেছিল চুপচাপ । অল্প অল্প হাওয়া বইছিল ক্ষেতটিতে। দুলুনিতে তার নিজেরও একটা ঘুমঘুম ভাব এসে গিয়েছিল। কিন্তু পাকা তালটি পড়ল বলেই না ভয় পেয়ে উড়াল দিয়েছিল।

চমৎকার বাসাটার ওপর দিকটার পাশেই দরজা। বাচ্চাদের মা যে কত দূরে গেছে খেতে! কখন আসবে কে জানে! পুঁচকে বাবা-পাখিটি তাই ছােট ছােট লাফে, অনেকটা খেজুর গাছিদের খেজুর গাছ থেকে নামার কায়দায় নামতে শুরু করল নিচের দিকে। আচমকা দুঃস্বপ্নের মতাে শূন্যে লাফিয়ে উঠল একটা প্রকাণ্ড সােনাব্যাঙ, পাখিটি তার মুখের ভেতরে ঢুকে গেল, প্রায়।

৪ ফুট উঁচু থেকে ব্যাঙটি আবার পড়ল ধানক্ষেতের ভেতর। খুব খুশি ওটা। চোখ দুটো আনন্দে চকচক করছে। লাঞ্চটা হবে আজ খাসা। কিন্তু মুখের ভেতরের শিকার নড়ছে না কেন! ব্যাঙটা ভাবল, মরে গেছে। তাই কায়দা করে খাবে বলে যেই না একটু ঢিলা দিয়েছে মুখে অমনি পাখিটি ব্যাঙকে চমকে দিয়ে উড়াল দিল। পিট পিট ডেকে ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল! বােকা ব্যাঙ উদাস থাকিয়ে রইল দুঃখী চোখে। এখানে জানার বিষয় দুটো :

১. সােনাব্যাঙেরা লাফ দিয়ে ছােট পাখি। শিকার করে।
২. পুঁচকে ওই পাখিটি অত্যন্ত ধূর্ত। বিপদে পড়ার পর মরার ভান করেছিল।

শিশু-কিশােরদের আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বলতে চাই যে, শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিনে এমন কি কার্তিকেও ধানক্ষেত বা ভেজা ঝােপঝাড়ের তলায় ওঁৎ পেতে থেকে সােনাব্যাঙেরা। বাবুই, চড়ুই, টুনটুনি, ভরত, মুনিয়া এমনকি দোয়েলও পাকড়াও করে খেয়ে ফেলে। আমি বহুবার এ রকম ঘটনা দেখেছি। অবাক টার্গেট সােনাব্যাঙদের। প্রায়ই সফল হয়। পুকুর-জলাশয় ধান-পাট ক্ষেতের জলের ওপরে ভেসে ছােট জাতের ব্যাঙেরা যেমন লাফ দিয়ে ফড়িং ও গংগাফড়িং ধরে ফেলে, সােনাব্যাঙের কৌশলটাও ও কম।


এবার এই পুঁচকে চতুর পাখিটির পরিচয় জানা যাক। বাংলা নাম ধানটুনি। নামটি আমার দেওয়া। ধানক্ষেতে বেশি থাকে, প্রায় সময় বাসা করে ধানগাছের আগা বা গোড়ার দিকে (ক্ষেতে জল থাকলে আগার দিকেই করে), তাই এই নাম। ঘাসিটুনিও বলা যেতে পারে। কেননা, উলুঘাস, খড়, কাশবন ও অন্যান্য জাতের ঘাসবনও এদের প্রিয় আবাস ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ইংরেজি নাম Zitting cisticola. বৈজ্ঞানিক নাম Cisticola Juncidis.শরীরের মাপ ৮-১২ সেন্টিমিটার। আমি নিজে কমপক্ষে ১২ বার ধানটুনির মাপভোকি নিয়েছি। ডিম-বাচ্চা-বাসা দেখেছি কমপক্ষে ১০০ বার। আমার সংগ্রহে দুটো বাসা আছে, একেবারে তাজা। বাসা বাসা বানায় ধানটুনি।

ধানটুনির শরীরের রঙ এক নজরে হালকা হলুদের আভাসহ লালচে বাদামি। পেটটি মেটে, সাদা গলা, গলার দু'পাশ ও বুকের রঙও একই। ডানা বুজানাে অবস্থায় পিঠের রঙ পেছনের আভাসহ বাদামি। মাথার তালু থেকে কালাে কালাে টান ও ছােপ ছিট লম্বালম্বিভাবে লেজের দিকে নামানাে। এই টান ও ছিটগুলাে পাখিটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। মায়াবী চোখ দু'টির ভেতরের রঙ সাদাটে পাটকিলে। লেজের প্রান্তে একটা অলিতাে সাদা টান। লেজের উপরিভাগের রঙ গুড়াে ইটের মতাে।

উড়লে ডানার প্রান্তের হালকা লালচে রঙ চোখে পড়ে। লেজের উপরিভাগের গোড়ার দিকটার রঙ গাঢ় পাটকিলে। ঠোট হালকা গোলাপি। পা ও পায়ের পাতি বা আঙুলগুলাে পুরােপুরি গােলাপি। জিভের রঙ ধাতব কালচে, তাতে নীলের অল্প ছোঁয়া। চোখের ওপর দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত একটা সাদাটে ঘোলাটে টান। ধনটুনির রঙ বছরে ৪ বার কিছুটা বদলে যায়। সবচেয়ে ভালাে রঙ ফোটে বসন্তে। বাসা বাধার মৌসুমেই রঙটা খােলে, বর্ষায় ম্লান হয় যদিও, বর্ষাকালেও ওরা সমানে বাসা বাঁধে।

এদের প্রধান খাদ্য ছােট ছােট পােকা, মাকড়সা ও তাদের ডিম। খাবার জন্য এরা ঘাসবন-ধানক্ষেতের তলায়ও নামে। এসব জায়গায় তারা। চমৎকারভাবে আত্মগােপন করতে জানে। বিপদ বুঝলে সহজে উড়বে না, আবার খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ঝোপঝাড় বা অন্য কোনাে গাছ থেকে খাবার খায় না। বিশাল ধানের মাঠের পাশে দাঁড়ালে ধানটুনিদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, দেখা না গেলেও ওদের তীক্ষ্ণ পিট পিট বা টিট টিট ডাক শােনা যাবে। অপুষ্ট (যে ধানে কেবল দুধ এসেছে) ধান ঠোটে চেপে ধরে ভেতরের দুধ এদের আমি খেতে দেখেছি, ছানাদেরও খাওয়াতে দেখেছি।

ধানটুনিদের বাসা বাঁধার মৌসুম শুরু চৈত্র মাস থেকে, চলে শরৎকাল পর্যন্ত। কাছাকাছি একই জায়গায় একত্রে ১৩টি ধানটুনির বাসাও আমি আমার গ্রামে দেখেছি। গরমকালে বাসা সাধারণত ঘাসবনের ঘাসের গােড়ায় ধানটুনিদের বাসাটা বলা যায় কলার মােচার মতাে। প্রবেশ পথটা থাকে ওপরের দিকের পাশে । ৰাসা লম্বায় ১৩-১৭ সেন্টিমিটার। উপকরণ সৰু ঘাস, মাকড়সার সাদা জাল, শক্ত ঘাসের আস্ত পাতা ইত্যাদি। বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে লাগায় ১-৩ দিন। বাসা বাঁধা শেষ করে ৩-৬ দিনে। দু'জনেই বাসা বানায়। এদের ডিম সাধারণত ৪টি, কখনাে ৫-৬টি। ডিমের রঙ চকচকে, তাতে অতি হালকা নীল ও বেগুনির আভা যেমন থাকে, তেমনি থাকে সাদাটে ভাব ও গাঢ় বাদামি ও কালাে নীল ছিটছােপ। দুজনেই পালা করে ডিমে তা দেয়।

ডিম ফুটে বাচ্চা বেরয় ১২-১৪ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১৩-১৫ দিনে। তবে তার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে, বসে থাকে ঘাসের আগায় বা ধানের ডগায়। পাশাপাশি বাসার কারণে অনেক সময় ঘাস বা ধানের ডগা নুয়ে মাটিতে পড়ে যায়। খুব সুন্দর ধনটুনির ছানারা। লেজ খাটো, বুক পুরনাে তুলাের মতাে সাদা, চেহারায় একটা গোলগাল ভাব থাকে। ৩৫-৪০ দিন ছানারা মা-বাবার সাথে থাকে। তারপর বেছে নেয় আলাদা জীবন। ধানটুনি বাংলাদেশের সব জায়গাতেই আছে। এরা খােলা মাঠের পাখি। ঘাস, ধানক্ষেত, নলখাগড়াবনই বিচরণ এলাকা। ঢাকা শহরের পুরনাে এয়ারপাের্টসহ শহরতলীতে এদেরকে দেখা যায়। অতি চতুর, কিন্তু নিরীহ স্বভাবের পাখি। এদের ভেতর যেন একটা বাউল বাউল ভাব আছে। ধাওয়া খেয়ে খােলা মাঠের ঘাস বা মটরশুটির ক্ষেতের তলায় হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া দায়।

খুব ভালাে অবস্থায় এরা আছে আমাদের দেশে। তবে সঙ্কট কিছুটা রয়েছে আর তা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশকে এদের খাদ্য ধ্বংস হয় । ডিমবাচ্চাও নষ্ট হয় কখনাে কখনাে, তবে এরা বোধহয় মানিয়ে নিয়েছে এসব।ভারত-মিয়ানমারসহ পৃথিবীর আরাে কিছু দেশে ধানটুনি আছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url