বাংলাদেশের পাখি : দুধরাজ

দুধরাজ
বাংলাদেশের পাখি : দুধরাজ

সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট এলাকা। জোয়ারের জল নেমে গেছে একটু আগে। এক ঝাক বনমােরগ নেমে পড়েছে ভেজা বনভূমিতে। সঙ্গে আছে অনেক বাচ্চা-কাচ্চা। ভেজা বনভূমিতে ওরা পােকামাকড় খুঁজছে ব্যস্তভাবে। ঝরাপাতার স্বপে পা ও ঠোট চালাচ্ছে। উল্টে-পাল্টে দেখছে ভালমতাে। একটি পােকা উড়ে কিংবা দৌড়ে পালাতে চাইলে ধাওয়া করছে দু’তিনটিতে মিলে। প্রয়ােজনে কিছুদর উড়ছেও।

কিন্তু উড়ন্ত পােকা ধরার কৌশলটা ওদের ভালমতাে জানা নেই। ওরা যে পােকাটিকে মিস করছে সে পােকাটিকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় উড়ে এসে মুখে পুরে নিচ্ছে অত্যন্ত সুন্দর একটি পাখি। একবারও মিস করছে না সে।

মােরগ-মুরগি গুলাের মাথার উপরে উপরে ঘুরছে সে। অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে লক্ষ্য রাখছে কোনাে কীটপতঙ্গ পােকামাকড় লাফ দেয় কিনা। লাফ দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে মনােরম ভঙ্গিমায় ডাইভ মেরে মােরগ-মুরগিগুলাের নাকের ডগা থেকে কীটপতঙ্গ ধরে আনছে, গাছের ডালে বসে অতি দ্রুত গিলে নিচ্ছে। তারপর আবারও উড়ছে মােরগ-মুরগিগুলাের মাথার উপরে উপরে। চোখ তার সতর্ক। সুন্দর ওই পাখিটি যে পােকামাকড় ধরে নিচ্ছে তাতে কিন্তু মােরগ-মুরগিগুলাে কিছুই মনে করছে না। কেননা পাখিটি বিনা কষ্টে পােকা ধরে নিলেও ক্ষতি নেই তেমন।

চবিবশ ঘণ্টায় সুন্দরবনে দু'বার করে জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ারের সময় বহু পােকামাকড় কীটপতঙ্গ বনভূমির বিশেষ বিশেষ জায়গায় এসে জড়াে হয়। জোয়ারের জল উপসাগরের দিকে নেমে যায় ধীরগতিতে। পােকামাকড়েরা আত্মগােপন করে তখন ঝরাপাতার ভেতরে। সুন্দর ওই পাখিটি মােরগমুরগিদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। বিনা কষ্টে সে ভুরিভােজ সেরে নিতে পারে। মােরগ-মুরগিদের ঠোট থেকেও সে মাঝে-মধ্যে কীটপােকা ছিনিয়ে নেয়। তবুও পাখিটিকে কিছু বলে না ওরা। বলে না তার কারণ, বিপদ দেখলেই পাখিটি সতর্ক সঙ্কেত দেয়। মােরগ-মুরগিগুলাে গাছে চড়ে আত্মগােপনের সুযােগ পায়। সুন্দর ওই দুধসাদা পাখিটিকে তাই ওরা ভালবাসে খুব, বন্ধু মনে করে। সুন্দরবনে কি শত্রুর অভাব আছে ! বনবিড়াল, অজগর সাপ, বাঘ, মানুষ। বিষধর সাপেরা সুযােগ পেলেই ছােট মুরগির বাচ্চাদের পাকড়াও করে। ডিম গিলে ফেলে। শিকারি পাখিরা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে। যায় বাচ্চাদের। এতসব বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়, অনেক সময় শত্রুর দিকে ধেয়ে যায় সুন্দর ওই পাখিটি। তাই তাকে ট্যাক্সস্বরূপ উড়ন্ত পােকামাকড় ধরার সুযােগ দেয়া উচিত।

কী রকম সুন্দর পাখি সে ! মাথায় রাজকীয় কালাে রঙের চুড়াে। যে কালােয় যেন ক্রিম মাখানাে থাকে সর্বক্ষণ ! কপাল কালাে। ঠোট নীলচে, তীক্ষ্ম এবং সামান্য আনুভূমিক বাঁকানাে। ঘাড়ের ওপরে যেন ব্যাকব্রাশ কালাে চুল। গলা কালাে। বুক কালাে। পিঠের অধিকাংশই কাগজের মতাে সাদা। পাখাগুটানাে অবস্থায় পাখার শেষ প্রান্তের দিকের বেশ কিছু পালকের ওপরে কালাে কালাে ছােপ রয়েছে। পেট সাদা। চোখের মণিটা নীল, তার ওপরে সূক্ষ্ম একটি সাদা বিন্দু। পায়ের রঙ হাল্কা লালচে। এইটুকু নিয়েই সে সুন্দর পাখি হতে পারত। তার উপরেও প্রকৃতি তাকে দিয়েছে স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত লেজ ও লেজের লম্বা দু'টি পালক, যা তাকে দিয়েছে অপরিসীম সৌন্দর্য। লেজ বলতে যা বােঝায় সেটুকুসহ মাপ নিলে ঠোটের অগ্রভাগ পর্যন্ত পাখিটির দৈর্ঘ্য হবে ১৯ থেকে ২১ সেন্টিমিটারের ভেতরে। লেজের অগ্রভাগ থেকে লম্বা যে সাদা পালক দুটি নেমে গেছে তার দৈর্ঘ্য হবে ওই ২১ সেন্টিমিটার থেকে ২৪ সেন্টিমিটারের ভেতরে। অর্থাৎ প্রায় সমান সমান। কিন্তু তার লেজের গােড়া থেকে মাপ নিলে ওই লম্বা দু’টি পালকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। একনজরে তাকে দেখলে মনে হবে লেজের তুলনায় তার দেহটি হবে তিন ভাগের এক ভাগ। সব মিলে সাদা-কালাের মিশানাে অসম্ভব সুন্দর এক পাখি সে বাংলাদেশে এমন সাদা সুন্দর পাখি আর একটিও নেই। ওই যে সে উড়ছে। সুন্দরবনের ভেতরে, মােরগ-মুরগিগুলাের মাথার উপরে উপরে, লেজের লম্বা দু’টি পালক উড়ছে দুধসাদা চুলের ফিতার মতাে, মসৃণ ও মােলায়েম ওই ফিতা বাতাসে ছন্দায়িত ভঙ্গিমায় নাচছে, দ্যুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তার দেহের সাদা অংশটুকুতে যেন ধাতব রঙের পালিশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র এক  সনীয় পাখি যেন চারদিকে ঝলমলে স্বপ্ন ছড়িয়ে উড়ছে। ওর দেহের সৌন্দর্য দেখে বাঘের বাচ্চারাও বােধহয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বানরের বাচ্চারা ওকে ধরে আদর করতে চায়। যদিও ওটা চোখ লাল করে তেড়ে আসে মাঝেমধ্যে।

সুন্দর এই পাখিটির নামও কিন্তু খুব সুন্দর। স্বর্গীয় পাখির মর্যাদা বােধহয় তাকে দেয়া হয়েছে। ইংরেজি নাম হচ্ছে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার। বাংলা নাম দুধরাজ। যে পাখিটির বর্ণনা তােমরা শুনলে এতক্ষণ সে হচ্ছে পুরুষ পাখি।

স্ত্রী পাখিটির কিন্তু লম্বা লেজ থাকে না, সে দেখতেও তেমন সুন্দরী নয়। তার মাথায়ও অবশ্য চুড়াে রয়েছে। রঙও কালাে, কিন্তু তাতে পুরুষের মতাে রূপের ঝলক ততটা নেই। পিঠের রঙ হাল্কা বাদামি, পেটের রঙে ধূসরের ভাগটা বেশি। তার সঙ্গে সাদার মিশ্রণ। ডানার উপরিভাগের রঙ ও লেজের রঙ পিঙ্গল। লেজ দেখতে চমৎকার। পুরুষটির সঙ্গে স্ত্রীকে মিলিয়ে দেখতে গেলে অবাক হতেই হয়। পুরুষটি যেন স্বর্গের পাখি। স্ত্রী এই পৃথিবীর। দু’টিরই থুতনিতে দু’চার গােছা করে খাড়া খাড়া চুলের মতাে সরু লােম আছে। স্ত্রী পাখি দেখলে সাধারণ একটি বুলবুল বলেই মনে হবে। হ্যা, এরাও এক ধরনের বুলবুল। শাহ বুলবুল। গানের পাখি লেজনাচুনের জাতভাই এরা। স্বভাব চরিত্র অনেকটা একই রকম। বাসার গড়ন ও ধরনের মিল রয়েছে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Terpsiphone Paradisi. স্বর্গীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত এই পাখিটিকে হয়তােবা দেখেছে অনেকে। যারা দেখেছে তারা নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছে ! মুগ্ধতার রেশ কাটে নি দীর্ঘ দিনেও। সে যখন শূন্য দিয়ে দুলে দুলে উড়ে যায় তখন তার এই সাদা ফিতার মতাে লম্বা দু’টি পালক কী সুন্দর ভঙ্গিমায় যে ছন্দায়িত হয়। বাতাসের অনুকূলে উড়লে ওই ফিতা তার মাথার ওপরে যখন উল্টে এসে পড়ে তখন তাকে একটি উড়ন্ত সাদা অর্কিড় বলেই মনে হয়। কী যে সুন্দর লাগে তখন দেখতে ! বাতাসের বিপরীতে উড়লে ওই দু'টি সাদা ফিতা টান টান হয়ে যায়। সে যখন গাছের ডালে বসে থাকে তখন ফিতার অগ্রভাগ আনুভূমিক বক্র হয়ে থাকে, অনেকটা টিপু সুলতানের তরবারির মতন। তার ওই সাদা ফিতার মাঝ বরাবর নীলচে একটা টান রয়েছে। ওই টানটা তার সাদা ফিতার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। হরিণ যেমন তার সুন্দর শিংয়ের জন্য বিপদে পড়ে, দুধরাজও তার সুন্দর লেজটির জন্য বিপদে পড়ে মাঝে-মধ্যে। আমার দেখা একটি ঘটনার কথা এই সুযােগে আমি বলে নিতে চাই। বাগানের ভেতরে চরছিল কয়েকটি মুরগি। একটি দুধরাজ উড়ছিল সঙ্গে সঙ্গে। একটি ফড়িংকে ধাওয়া করে সে নেমে পড়ে মাটিতে। পনেরাে দিন বয়সী একটি মুরগির বাচ্চা আচমকা ধরে ফেলে ওর লেজের অগ্রভাগ । দুধরাজটি ভয়ে কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে—কই কোঁ কি ই ই ই ক্যাচ..। উড়তে চায়, পারে না। লেজ ধরে রেখেছে বাচ্চাটি। দুধরাজটি মুক্তি পাবার জন্য পাগল। এদিকে বাচ্চাটির মা ভেবেছে বাচ্চাটি বিপদে পড়েছে। ওই পাখিটি বােধ হয় বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে। কক কক’ ডেকে সে তেড়ে এল। দুধরাজকে ঠোকর মারল। দুধরাজটি টানাটানি করছে। একটি ফিতা সে মুরগির ঠোটে রেখে তবেই না মতি পেল। শুধু এই নয়, লম্বা লেজের জন্য সে সাপ, গুইসাপ, বেজি ও বনবিড়ালের কবলে পড়ে। শিকারি পাখিরাও তার ওই লম্বা লেজ ধরে কাবু করে ফেলে। ওই লেজ বেশ শক্ত। উঠে গেলে ধীরে ধীরে আবারও গজায়। ছােটকালে আমার। সংগ্রহে দুধরাজের ৫ খানা পালক ছিল।

দুধরাজ গানের পাখি। কিন্তু গায়ক হিসাবে সে তৃতীয় শ্রেণীর। গলার স্বর ককশ। পাঁচ রকমভাবে ডাকতে পারে সে। অবশ্য ডাকাডাকি সে সহজে করে। যখন বাসা বাঁধে তখন ওরা দু জনে মিলেই গান গায়। এ সময়ে অবশ্য ওদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর গায়ক হিসাবে স্বীকার করে নেয়া চলে। ওরা ছায়া ঢাকা বনবাগান পছন্দ করে, ওই লেজনাচুনের মতােই। চঞ্চল পাখি। কিন্তু খাবার খোজার সময় অতটা চঞ্চল নয়। সুন্দরবনের হরিণ-শূকর কিংবা গ্রামের গরুছাগল-মােষরা যখন ঘাস খায়, ঝােপঝাড়ে নাড়া দেয়, শূকর মাটি খোড়ে, তখনই ওরা সুযােগ নেয়। অর্থাৎ উড়ন্ত কীটপতঙ্গ ধরে খায়। তবে ওদের স্বভাব এমনই যে ওরা এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। এই আছে তাে এই নেই। তবে বাসা বাঁধার পর এক জায়গায় তাে থাকতেই হয়। বাসা বাঁধে দো-ডালা বা তে-ডালার ভেতরে। ছিমছাম মাঝারি বাসা নরম ঘাস-লতা-মাকড়সার জাল ও ডিমের সাদা খােলস হচ্ছে বাসার প্রধান উপকরণ। ডিম হয় ৪টি। মাঝেমধ্যে ৩টি কিংবা ৫টি দেখা যায়। সব ডিম ফোটে না। যে ক'টি বাচ্চা হয় তার সবও শেষ পর্যন্ত টেকে না। টেকে না বলেই বাংলাদেশে ওরা চিরকালই অত্যন্ত অল্প সংখ্যায় ছিল। আজও তাই আছে। খুব কম দেখা যায়। বাসা বাঁধে মূলত গ্রীষ্ম-বসন্তে। হেমন্তেও দেখা যায়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url