বাংলাদেশের পাখি : ছাতারে

এই পাখিটির নাম ছাতারে। ইংরেজি নাম Jungle babbler বৈজ্ঞানিক নাম Turdoides striatus, লম্বায় হয় ২৯ সেন্টিমিটার।


বেতঝােপের ভেতরে খেলছে তিনটি খরগােশের বাচ্চা। বয়স ওদের কম। শরীরে রঙ ফোটে নি। হাবাগােবা চেহারা। মিষ্টি-মিষ্টি চাহনি। খেলছে জড়াজড়ি করে। লম্বা লম্বা কান মাঝে-মাঝে খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করছে–আশেপাশে কোনাে বিপদ আছে কিনা। ওদের মা-বাবা একটু ওপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে।

খেলতে খেলতে বাচ্চা তিনটি ঝােপের বাইরে চলে এল। সামনেই খােলা মাঠ। মাঠভরা সর্ষে ফুল। রােদ পড়ে হলুদ ফুলগুলাে যেন জ্বলছে। দু’টি পাখি চরছে মাটিতে। সর্ষেক্ষেতের কিনারে। ওরা এগােচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ওগুলােকে দেখে খরগােশের বাচ্চা তিনটি ভয় পেল না। পাখিগুলােও এগিয়ে আসছে বাচ্চা তিনটির দিকে। যেনবা একসঙ্গে খেলবে।

আচমকা একটি পাখি কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাঁচটিও যােগ দিল। সে কী চেঁচামেচি! তারপর উড়ল খরগােশের বাচ্চা তিনটির মাথার ওপর দিয়ে। বসল গিয়ে চালতা গাছের ডালে। খরগােশের বাচ্চা তিনটি সই করে ঘুরেই ছুটল বেতঝাড়ের দিকে। সর্ষেক্ষেতের ভেতর থেকে যেন উড়ে এল একটি বনবিড়াল (Jungle Cat) ।

অল্পের জন্য মিস করল শিকার। শিকার মিস করেও সে দুটল খরগােসের বাচ্চা তিনটির দিকে। ছােটা না বলে লাফ দেয়া বলাই ভালাে। খরগােশ মা-বাবাও ততক্ষণে ঝােপঝাড় ডিঙিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে। পেছনে বনবিড়াল। চেঁচিয়ে বাগান মাত করছে পাখি দু'টি। বাচ্চা তিনটিও ছুটছে প্রাণপণে ।

এই যে সতর্ক সঙ্কেত দেওয়া, যে সঙ্কেত ওই পাখিরা যেমন দিতে পারে, বাংলাদেশের খুব কম পাখিই তা পারে। ওরা শুধু গ্রামের বনবাগানেই সতর্ক সঙ্কেত দেয় না, সুন্দরবনেও ওরা এভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হামলার কবল থেকে বাঁচিয়ে দেয় হরিণ-শূকরদের। সিলেটচট্টগ্রামের জঙ্গলেও চিতাবাঘ, গেছােবাঘের হামলা থেকে বাঁচিয়ে দেয় নিরীহ প্রাণীদের। গুটি মেরে যখন শিকারের দিকে এগােচ্ছে বাঘ-চিতাবাঘ বা বনবিড়াল—তখনই সতর্ক সঙ্কেত দেয়। বাঘ-চিতাবাঘ আর বনবিড়ালের মেজাজ যায় খিচড়ে।

নিরীহ পাখি ও বন্যপ্রাণীদের বন্ধু এই পাখিটির নাম ছাতারে। সাতভাইও বলা হয়। ইংরেজরা বলে সেভেন সিস্টার' বা 'সাতবােন' পাখি। এই নামের পেছনে যুক্তি আছে। এরা ছােট ছােট দলে থাকে। প্রতি দলে ৫ থেকে ৭টি পাখি থাকে। প্রায় সময়েই চেঁচায় বা ডাকাডাকি করে। মনে হয় নিজেদের ভেতর ঝগড়া-ফ্যাসাদ করছে। আসলে তা নয়।

ছাতারে (Jungle Babler) বাংলাদেশের সব গ্রামেই আছে। ভালো অবস্থায় আছে। ওদের খাবারের অভাব যেমন নেই, তেমনি নেই বাসা বাঁধার জায়গার অভাব। মাটিতে নেমে ওরা ঝােপ-জঙ্গল ঠেলে ও শুকনাে পাতা উল্টে খাবার সংগ্রহ করে। এতে বন-বাগানের মাটির যেমন উপকার হয়, তেমনি গাছপালার স্বাস্থ্যও ভালাে থাকে। ক্ষতিকর পােকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খেয়ে ওরা পরিবেশকে ভালাে রাখে। ছাতারেরা তাই উপকারী পাখি। প্রকৃতির বন্ধু।

সারা দুনিয়ায় ছাতারে আছে ত্রিশ রকমের। বাংলাদেশে আছে সাত রকম। সবারই স্বভাব-চরিত্র, খাদ্য ও বাসা প্রায় একই রকম।

ছাতারে লম্বায় হয় ২৯ সেন্টিমিটার। চওড়া ধরনের কলম্বাটে লেজ। চওড়া পাখা। তবুও ওরা এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ উড়তে পারে না। বেশি উঁচুতেও ওঠে না। তবে একটু দূরে যখন উড়ে যায়, তখন ডানা থাকে স্থির, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই বলে ছাতারেদের সুন্দর পাখি বলা যাবে । ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। মেটে-বাদামি শরীরের রঙ।

চোখের মনি লাল। পা, ঠোট ও তলপেট হালকা হলুদাভ। গলার স্বর কর্কশ। গলায় জোর আছে বেশ।
কোনাে গাছে কলা, পেঁপে বা আম পাকলে ছাতারেরা আগে-ভাগে খবর পেয়ে যায়। নানান রকম ফল যেমন ওরা খায়, তেমনি খায় পোকামাকড় ও কেঁচো। মাছও খায়। ধান ও ভাত খেতে ওরা গ্রামের বাড়ির উঠোনেও চলে আসে। সুযােগ পেলে ঘর ও রান্নাঘরেও ঢুকে পড়ে। বর্ষাকালে উঠোনবাড়িতে বেশি আসে। বাল্য-কৈশােরে আমি বহুবার মুরগি ঢাকা খাচার ফাঁদ পেতে ছাতারে আটকেছি। আটকা পড়লে ওরা কি একটুও ডাকাডাকি করে না। নার্ভাস হয়ে পড়ে। ভয়ে চোখ যায় ঘোলাটে হয়ে ।

ওরা বাসা করে ঝােপঝাড় ও গাছের ডালে। বেশ বড়সড় গােলগাল বাটির মতাে বাসা। দুজনে মিলে জায়গা নির্বাচনে ব্যয় করে ২-৩ দিন। দু'জনে মিলেই বাসা বাঁধা শেষ করে ৪-৮ দিনে।

ডিম পাড়ে ২-৪টা। তবে প্রায় সময়েই হয় ৩টা ডিম। ডিমের রঙ নীল। ওই ডিমের সাথে মিল আছে কোকিল, পাপিয়া ও বউ কথা কও পাখির ডিমের। ওই সব পাখিরা তাই সুযােগ পেলেই ছাতারের বাসায় গোপনে ডিম পাড়ে। ছাতারেরা ওই ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফোটায়। ছাতারেরা ডিমে তা দেয় পালা করে। ১৩-১৫ দিনে বাচ্চা ফোটে। বাবা-মাতে খাওয়ায় চাচা-ফুফু-খালা-খালুরাও খাওয়ায়। অর্থাৎ দলের বড়রা ছােটদের খাওয়ায়, সমান ভালােবাসে। আবার সময় সুযােগ মিললে একজনের ডিমে অন্যরাও তা দেয়। বাচ্চারা উড়তে পারে ১৭/১৮ দিনে।

ছাতারেরা নিরীহ ও গােছের পাখি। পােষ মানে। পাশাপাশি, প্রয়ােজনে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। ঢাকা শহরের শিশু-কিশােরেরা ইচ্ছে করলে ঢাকা শহরের পার্ক, বােটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা এলাকায় গিয়ে ছাতারেদের কর্মকাণ্ড দেখে আসতে যেমন পারে, তেমনি পারে ওদের কর্কশ ডাক শুনতে। দেখতে পারে ওদের ওড়ার চমৎকার কৌশলটা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url