বাংলাদেশের পাখি : শামুকভাঙ্গা

বাংলাদেশের পাখি : শামুকভাঙ্গা
এই পাখিটির নাম শামুকভাঙ্গা। শামুকখােল, শামুকখেকোও বলা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে এর আরাে কিছু আঞ্চলিক নাম রয়েছে। ইংরেজি নাম Asian open-bill। বৈজ্ঞানিক নাম Anastons oscitats। শরীরের মাপ ৯৯ সেন্টিমিটার।


ফাগুন মাস। মেঘলা আকাশ। বাতাস বইছে বেশ জোরে। ওই বাতাসের অনুকূলে উড়ে আসছে বিশাল এক ঝাঁক পাখি, সংখ্যায় প্রায় তিন শ'। ওরা আসছে বনবাগানের মাথার বেশ ওপর দিয়ে। ওরা আসছে যেন বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে। ওরা আসছে পাশাপাশি সারিতে। সারির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের দূরত্ব ৫০ মিটারের কম হবে না। অবশ্য সারিটা একেবারে সরলরেখায় নয়। কিছু পাখি সামান্য এগিয়ে আছে, কিছু পাখি পিছিয়ে। তবে রেখাটা ঠিকই আছে। উড়ছেও সমান গতিতে। পাখা নাড়ছে খুব কম।

যেন বা হিসেব কষে একই সঙ্গে পাখা নাড়ছে ওরা, থামছেও একই সঙ্গে। তারপর বেশ কিছুদূর এগােচ্ছে বাতাসে ভেসে, আবারাে নাড়ছে পাখা দুতিনবার করে। ওদের যেন তাড়া নেই কোনাে।
শেষ বিকেল এখন। আকাশ মেঘলা থাকায় দিনের আলাে নিভে আসছে দ্রুত। আলাে থাকতে থাকতেই পাখিগুলোকে আশ্রয় নিতে হবে যুৎসই কোনাে গাছে। কেননা, রাতের অন্ধকারে ওরা একেবারেই অসহায় । চাঁদনি ব্রাতে অবশ্য প্রয়ােজনে উড়তে পারে। তারাভরা রাতেও ওরা উড়তে পারে
বেদিশার মতাে। তবে বিপদে না পড়লে রাতে এই পাখিরা কখনাে রাতের আশ্রয়স্থল ছেড়ে পাখা মেলে না।

পাশাপাশি লাইনে কী সুন্দর উড়ে আসছে বড় বড় পাখিগুলাে! লম্বা লম্বা পাগুলাে ওদের লেজের তলা দিয়ে পেছন দিকে টানটান হয়ে আছে। বাতাসের ধাক্কায় মাঝে মাঝেই লেজ ও পিঠের দু’পাঁচটি পালক উল্টে যাচ্ছে। তবুও উড়ছে ওরা ধীরগতিতে, যা ওদের স্বভাব।

পাখিগুলাে আসছে সুন্দরবনের দিক থেকে। ওদিকেরই কোনাে জলাভূমি বা নদীর চরে ওরা খাবার খুঁজেছে দিনভর। এখন গ্রামের দিকে আসছে রাতের আশ্রয়ের সন্ধানে। মেঘলা দিন না হলে ওরা আরাে দেরি। করে আকাশে উড়ত ।

সবুজ বনবাগানে নেচে বেড়াচ্ছে পাগলা হাওয়া। মেঘলা দিনে সবুজ বনবাগানকে দূর থেকে লাগে কালচে-সবুজ। ও রকম একটি কালচে-সবুজ এলাকা পার হয়ে পাখির ঝাঁক এসে পড়ল ছােট একটি খােলা মাঠের ওপরে। শুকনাে মাঠটি প্রায় গােলাকার। মাঠের কিনারা জুড়ে কী সুন্দর সবুজ বেষ্টনী। বেষ্টনীর জায়গায় জায়গায় মাথা উচু করে আছে বড় বড় কাঠবাদাম, নারকেল আর দেবদারু গাছ।

একটি মরা নারকেল গাছের মাথায় বসে আছে একটি রাজ শকুন। ওটা ওর রাতের স্থায়ী আস্তানা। একটি দেবদারু গাছের মাথায় রাতের আশ্রয় নিয়েছে তিনটি মানিক জোড়। দূরের একটি জলাশয়ে দিনভর চরেছে ওরা। বিশাল এক ঝাক বড় সাদা বক মাঠ পাড়ি দিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে।

মাঠের ভেতরের একগুচ্ছ শ্যাওড়া গাছের ভেতর প্রচণ্ড কোলাহল জুড়েছে একঝাক ভতিশালিক। রোজ রাতেই ওরা আশ্রয়। নেয় এখানে। ছােট এক রাখাল বালক তার গরুর পাল নিয়ে ফিরে চলেছে বাড়ির দিকে। একজোড়া শিয়াল পশ্চিমের বাগান থেকে বেরিয়ে মাঠটি পাড়ি ধরেছে আড়াআড়ি।

খেকশিয়ালের তিনটি ছানা মাঠের ধুলােয় প্রচণ্ড হুটোপুটি লাগিয়েছে। মাঠের ভেতরের তালগাছগুলাে ঘিরে ওড়াওড়ি করছে বাতাসীরা। একটি তালগাছের পাতার ওপরে চুপচাপ বসে আছে একটি অসপ্রে পাখি। চোখ ওর মাঠের দিকে। ব্যাঙ-হঁদুর দেখলেই ঝাপিয়ে পড়বে এই তুখােড় শিকারি পাখিটি।

বিশাল ওই পাখির ঝাকটি মাঠটির মাঝ বরাবর এসে একটু যেন থমকে গেল। সামনের সর্দার পাখিটি একটু ওপরে উঠল, তারপর বাঁক নিল বা দিকে। সর্দারকে অনুসরণ করতে গিয়ে পাখির ঝাঁকের লাইনটা ভেঙে গেল বটে, রইল ওরা কাছাকাছি। এই মাঠটির চার কিনারাতে তাে বটেই, মাঠের
ভেতরেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু শিমুলগাছ। এই পাখিদের প্রথম পছন্দের গাছই হচ্ছে শিমুল। পাতা কম। ডালপালাও থাকে মাটির সমান্তরালে ছড়ানাে-ছিটানাে। লম্বা পা নিয়ে এইসব ডালে বসতে যেমন সুবিধে, তেমনি সুবিধে হাঁটু মুড়ে যুৎসই হয়ে বসতে। এইসব ডাল থেকে উড়তেও সুবিধে। পাখা ঝাপটালে ডাল-পাতায় আঘাত লাগে না।

কোন গাছটিতে নামা যায় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সর্দার আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল নিচের দিকে ধীরলয়ে পাক খেতে খেতে । লক্ষ্য তখন মাঠের ভেতরের একটি বড়সড় শিমুলগাছ—যে গাছটির পাশে দাঁড়ানাে বড় বড় তিনটি তালগাছি ও দু'টি ছােট শিমুলগাছ।

গাছের মাথা থেকে অনুমান ১০ মিটার উচ্চতায় এসে বিমানের চাকা নামিয়ে দেবার কায়দায় সর্দার পাখিটি নামিয়ে দিল তার লম্বা দু'টি পা, বসল এসে ডালে। তখনাে পাখা দুটি মেলা তার। ভালােভাবে বসা হয়েছে বােঝার পর পাখা দু'টি বুজালো সে। তারপর একে একে নামতে লাগল অন্য পাখিগুলাে।

একই কায়দায়। একটু বাদেই শুরু হল ধাক্কাধাক্কি অবস্থা। বড় শিমুলগাছটিতে আর পা ফেলার জায়গা নেই। তবুও কিছু পাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে জায়গা খুঁজছে। কিছু পাখি বসছে গিয়ে ছােট দুটি শিমুলের ডালে। ও দুটো গাছেও যখন পা ফেলার জায়গা নেই, তখন তিনটি পাখি বাধ্য হয়েই বসল গিয়ে তালগাছটির ডগার ওপরে। ব্যস, আজকের মতাে রাতের আশ্রয় পেয়ে গেছে এরা। বড় কোনাে ঝামেলা না হলে রাতের ভেতরে উড়বে না আর । উড়বে আবার আগামী দিন ভােরে। ধীরলয়ে পাখা মেলে চলে যাবে কোনাে জলাশয়ের দিকে। খাদ্য খুঁজবে হেঁটে হেঁটে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাখিগুলাে পাশাপাশি ঠেলাঠেলি করে না বসলেও পারত। মাঠের ভেতরে রয়েছে আরাে শিমুলগাছ। ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাগ ভাগ হয়েও বসতে পারত। কিন্তু না, এই পাখিদের স্বভাবই এমন; গাছে জায়গা না হলে গাছতলার মাটিতে বসতে এরা রাজি আছে, কিন্তু দলছুট হয়ে দূরে বসবে না। এ রকম মাটিতে বসা পাখি আমি বলিকৈশােরে বহুবার দেখেছি। নিজে খেপজাল দিয়ে ধরেছি । গুলি করেছি। মাটিতে বসা—এমনকি গাছে বসা পাখিকে বনবিড়াল ও মেছােবাঘের কবলে পড়তে দেখেছি। মাটি থেকে শিয়াল খাটাসেও ধরেছে। এখানে আমার একদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি।

তখন আমি কিশাের। বােশেখ মাস। বিকেলে আকাশ ঢেকে গেল। মেঘে। শুরু হল ঝড়াে হাওয়া। তখন তাড়াতাড়ি গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফেরার পথে দেখলাম একঝাক পাখি দ্রুতবেগে উড়ছে নিচু দিয়ে, যুদ্ধ করছে। ঝড়াে হাওয়ার সঙ্গে। তড়িঘড়ি নেমে পড়ল ওরা মাঠের ভেতরের মস্ত বড় শিমুলগাছটির মাথায়। সেই বয়সের অভিজ্ঞতা আমার এ রকম যে, এই পাখিরা ঝড়ো হাওয়ার কাছে একেবারেই অসহায়, ঝড়ের দিন বা রাতে এরা প্রয়ােজনে খোলা মাঠে নেমে পড়ে। বসে থাকে অসহায়ের মতাে।

রাতের অন্ধকারে এরা একেবারেই অসহায় মাটিতে বসা পাখিকে হাত বাড়িয়ে ধরা যায় সহজে। অবশ্য ধরার পরে শক্তি খাটায়, পাখা ঝাপটায়, ঠোটও চালায়। ঠোটের চোটটা বেশ ভারি হয়। এরা বেশ নিরীহ ও বােকাসােকা ধরনের পাখি। বন্দুক নিয়ে বেশ কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু একবার গুলি খাওয়া ঝাকের প্রতিটি পাখিই চালাক হয়ে যায়। মানুষকে তখন নাগালের ভেতরে পেীছাতে দেয় না। মাঠে ছাড়া গাছে বসা অবস্থায় গুলি করলে একটির বেশি শিকার করা হয় কষ্টকর। সেই কিশাের বয়সেই এই পাখির ঝাঁকে গুলি করার অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করে ফেলেছিলাম।

তাে সেই কাল-বােশেখির বিকেলে পাখির ঝাঁককে শিমুলগাছে নামতে দেখে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিয়েছিলাম বাড়ির দিকে। বাবাকে খবরটা বলতেই তিনি বন্দুক-কার্তুজ বের করেছিলেন। তখন ঝড়ের গতি গিয়েছিল বেড়ে। বৃষ্টিও নেমেছিল মুষলধারায়। হঠাৎ করে ঘাের অন্ধকার নেমে পড়েছিল চরাচরে। অস্থির অপেক্ষা তখন বৃষ্টি কমার, ঝড় থামার। না, দুটোই বাড়ছে। নারকেল-সুপারি-আম-জামগাছের মাথায় ঝড়ের সে কী মাতম! গােয়াল চাপাপড়ার ভয়ে বাড়ির সবগুলাে গরুর গলার দড়ি খুলে দিয়ে বাবা ফিরে এলেন আবার। ওই সময়ই পাখি শিকারি বাবা আমার বন্দুক ছাড়া পাখি শিকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। খেপজাল, ছাগলৰাধা দড়ি আর দু'সেলের একটি টর্চ হাতে যখন বাবা, আমার এক মামা ও কাজের লােকটি নেমে পড়লেন উঠোনে, তখন আমিও নামলাম। বাবার প্রচণ্ড ধমকও ফেরাতে পারল না আমাকে, মাও হাত ধরে রাখতে পারলেন না।

খােলা মাঠে নামার পরে আমরা এগােতে পারি না আর। পায়ের তলায় নরম মাটি। ঝড় আমাদের মাটিতে পেড়ে ফেলতে চায়। তুমুল বৃষ্টির চাপে দমবন্ধ অবস্থা। তবুও খোলা মাঠে গাছচাপা পড়ার ভয় নেই, ভয় আছে সাপের গায়ে পা পড়ার। কী কৌশলে যে বাবা লুঙ্গির আঁচলে চাপা টর্চটা মাঝে মাঝে জ্বালাচ্ছেন। ঘােলাটে আলাের বৃত্তে চারপাশটাকে মনে হচ্ছে। ভৌতিক। ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বৃষ্টির সঙ্গে লড়তে লড়তে এক সময় পৌঁছে গেলাম শিমুলতলায়। ঘােলাটে আলাের বৃত্তে আমরা অনেকগুলাে পাখিকে মাটিতে জড়সড় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বাবা চিৎকার দিয়ে বললেন, ঝড়ের জন্য গাছের সবগুলাে পাখি মাটিতে নেমে এসেছে। সেই ঝড়-বৃষ্টির ভেতরেও আমি কাছাকাছি এতগুলাে বড় বড় পাখি দেখে কী রকম উল্লাসিত যে হলাম! তাড়িয়ে জালে পাখি ফেললাম।
বিপদের গন্ধ পেয়ে ওরা দৌড়ে-হেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। যখন আমরা ফিরতি পথ ধরলাম, তখন ছাগলের দড়িতে বাঁধা পড়েছে ১৯টি পাখি। এখন (২০০৮) আমার বয়স অনেক। সেই রাতটি আজো আমার কাছে স্বপ্নের মতাে মনে হয়। বিনা বন্দুকে এই জাতের পাখি একসাথে এতগুলাে পরে আর কখনাে পাকড়াও করতে পারি নি। সেই রাতে চেষ্টা করলে আরাে বহু পাখি আমরা ধরতে পারতাম। চেষ্টা করি নি। শীতে কাঁপছিলাম সবাই। পাশাপাশি এই পাখি নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি ৫ বার। আমার বাবারও ও রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১১ বার। 'আমাদের এলাকার আরাে অনেক বন্দুক শিকারির একই রকম অভিজ্ঞতা ছিল।

যে অভিজ্ঞতাটির কথা আমি বলছি, সেটি ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের হেমন্তকালে। আমাদের গ্রামের পরের গ্রামে গিয়েছিলাম হাডুডু খেলা দেখতে। ফেরার পথে দেখি ওই গ্রামের একটি জলাভূমির প্রান্তের মস্তবড় কাঠবাদাম গাছটির মাথায় বসে আছে ৩টি পাখি। সন্ধে নামতে বাকি নেই বেশি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি এলাম। বাবা বাড়ি ছিলেন না। মাকে বললে সন্ধ্যেবেলায় বন্দুক হাতে পাশের গ্রামে কিছুতেই যেতে দেবেন না। আমাকে। তাই এক বন্ধুকে নিয়ে মাকে না বলেই বন্দুক নিয়ে রওয়ানা হলাম। রাতের বেলায় গাছে বসা পাখিকে তারা বা চাদের আলাের পটভূমিকাতে কীভাবে টার্গেট করতে হয়, বাবা আমাকে তা হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন।

কাঠবাদামের তলায় যখন এলাম, তখন অন্ধকার নেমে গেছে চরাচর জুড়ে। গাছতলায় গিয়ে আমি একটি পাখিকে চিহ্নিত করলাম। এলজি কার্তুজে গুলি করলাম। ডাল-পাতায় শব্দ তুলতে তুলতে গাছতলার ঝােপের মাথায় আছড়ে পড়ল পাখিটি। ভয়ে চিৎকার দিয়ে বনবিড়ালের দুটি হানা ছিটকে বেরুলাে ঝােপ থেকে, টর্চের ফোকাস দেখে দৌড়ে পালাল জোরসে। ঝােপের কাছে পৌঁছে উবু হয়ে পাখিটি তুলেই দেখি—এটা একটি রাজশকুন (King Vulture)।

গাছে বসেছিল ৩টি অন্য জাতের পাখি, রাজশকুন এল কোথেকে? এর জবাব এবার আমি তুলে ধরছি। এই পাখিরা যেসব গাছে বসতে পছন্দ করে, ভালােবাসে রাতের আশ্রয় নিতে; শকুন, রাজশকুন (রাজশকুন বাংলাদেশে এখন আর দেখা যায় না। শকুনও কমে গেছে অনেক) ও বড় জাতের ঈগলরাও সেইসব গাছে বসতে বা রাতে আশ্রয় নিতে ভালােবাসে। এই কারণেই সেই রাতে আমি আসল পাখির পরিবর্তে শকুন শিকার করেছিলাম। বন্দুক হাতে ফিরে আসার আগেই রাজশকুনটি ওই ৩টি পাখিকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করেছিল। আবার একই গাছে এই পাখি ও শকুনদের সহাবস্থানও আমি বহুবার দেখেছি। পর্যাপ্ত জায়গা থাকলে শকুনরা আর এদেরকে গাছছাড়া করে না।

এক বিকেলে আমি (১৯৬৯ সাল) একটি আমগাছে বসা ১১টি এই জাতের পাখির ৩টিকে এক গুলিতে পেড়ে ফেলেছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ওই একই গাছে বসা ৯টি শকুন গুলির প্রচণ্ড শব্দেও ওড়ে নি, বরং গলা বাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল ব্যাপারটা কী ঘটল এখানে! ওরা ৮ জন উড়ে গেল কেন, ৩ জন মাটিতেই বা পড়ল কেন? শকুনদের কেউ গুলি করে না। শকুনেরা তাই গুলিকে ভয় পায় না, শব্দে হয়তাে আতঙ্কিত হয় সামান্য। এবার জানা যাক এই পাখিটির পরিচয়।

পাখিটির নাম শামুকভাঙ্গা। শীমুকখােল, শামুকখেকোও বলা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে এর আরো কিছু আঞ্চলিক নাম রয়েছে। ইংরেজি নাম Asian open-bill। বৈজ্ঞানিক নাম Anastotus oscitans । শরীরের মাপ ৯৯ সেন্টিমিটার। আমি নিজে বহুবার এই পাখিটির মাপজোক ও ওজন রেকর্ড করেছি। পা, ঠোট, জিভ, ঠোটের মাঝামাঝি জায়গাটার যেখানে একটু ফাকা মতন, ওই ফাঁকটুকু ধরে মাপসহ দাঁড়ানাে অবস্থায় মাটি থেকে ওর মাথা পর্যন্ত কতটুকু উচু তাও রেকর্ড করেছি। শামুকভাঙ্গার ঠোট আমার সংগ্রহে রয়েছে। মাটিতে দাঁড়ানাে অবস্থায় এর উচ্চতা প্রায় এর শরীরের মাপের সমান।

বড়-সড় এই পাখিটির চেহারায় একটু বােকা বােকা ভাব যেমন আছে, তেমনি আছে নিরীহ নিরীহ চাহনি। মাথার চাদি থেকে ঘাড়-গলা-বুক-পেট হয়ে লেজের তলা পর্যন্ত সাদা। এই পাখিটির লেজের তলার কিছুটা ও উপরিভাগের কিছুটা কালাে। বুজানাে অবস্থায় ডানার অধিকাংশই সাদা, শুধু প্রান্তদেশটা কালাে। তবে ঋতুভেদে এই যে সাদা রঙ, তা যেমন কিছুটা ঘােলাটে ফ্যাকাশে হয়, তেমনি কালাে রঙটাও হয় কিছুটা বিবর্ণ। এদের ঠোট লালচে-বাদামি। ঋতুভেদে এই রঙও বদলায়। পা হচ্ছে লালচে-হলুদ। লম্বা পায়ের একটিকে তুলে নিয়ে অন্যটির ওপর ভর দিয়ে এরা যেমন দিব্যি বিশ্রাম করতে পারে, তেমনি পারে দু'পা চমৎকারভাবে ভাজ করে আরাম করে বসতে।

শামুকভাঙ্গা মূলত জলাভূমির পাখি। তবে এদের জাতভাই মদনটাক, রঙিলা বক ও হাড়গিলার (হাড়গিলা বর্তমান বাংলাদেশে নেই বােধ হয়) মতাে শুকনাে জমিতেও চরে ব্যাঙ ও ফড়িংসহ পােকা-মাকড় খাওয়ার জন্য। এদের পেটে আমি বহুবার আস্ত ছােট ঝিনুক-শামুক, জর্জেক ও জলসাপ দেখেছি। এদের খাদ্য তালিকায় আছে মাছ, কাঁকড়া, শামুকের ডিম, কচ্ছপের ছােট ছানা। ঝাকবেঁধে এরা যখন জলাভূমিতে হেঁটে খাবার খোজে, তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে । অন্য জাতের পাখিকে ভয় দেখাবার জন্য এরা দু'ঠোটে চমৎকার ঠোটতালি' বাজায়। শব্দ ওঠে খটখট খটখট। আনন্দ ও উত্তেজনায় এরা ঠোটতালি বেশি বাজায়। যথেষ্ট শক্ত ও চোখা এদের ঠোট কিন্তু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে এই ঠোটের ব্যবহার এরা জানেই না বলতে গেলে।

শামুকভাঙ্গারা বাসা বেশি করে ভদ্র মাসে। জ্যৈষ্ঠ মাসেও বাসা করতে দেখেছি আমি। শামুকভাঙার শেষ বাসাটি আমি দেখেছিলাম ১৯৯২ সালের শরৎকালে, সুন্দরবনের বাইরের একটা তেঁতুলগাছে। অবশ্য, ২০০৭ সালে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার শাখিদার পাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ পাখির কলােনি বাসা দেখি। এক জোড়া পাখি ছিল সেই ১৯৯২ সালে। তবে এক গাছে কয়েক জোড়া পাখি মিলেও বাসা করে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলাদা আলাদা গাছেওঁ করে। দুজনেই বাস সাজায়। পুরুষটি উপকরণ বেশি আনে। মেয়েটি গাছে বসে থাকে, উপকরণ সাজায়।

প্রধান উপকরণ গাছের শুকনাে বা কাচা ডালপাতা, শুকনাে খড়। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ৭-৯ দিন। পছন্দের জায়গা খুঁজতে লাগে ২-৩ দিন। এই পাখিরা দলে থাকে, থাকে দলপতি। দলপতিই দল চালায়। শামুকভাঙ্গাদের ডিম হয় ৩টি। ২টি বা ৪টিও হয়। ডিমের রঙ ঘােলাটে সাদা। দুজনেই পালা করে ডিমে তা দেয়। ৩০-৩৩ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। দুজনেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।

বাচ্চার উড়তে শেখে ৫০-৬০ দিনে। তারপর থেকে মা-বাবার সঙ্গে উড়ে ঝাকে মেশে। শীতকালে বিশাল ঝকে থাকে অনেক বাচ্চা। বােকা-বােকা। চাহনি আর রঙ দেখে বাচ্চাদের আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। গুলির শব্দ শুনে বয়স্ক পাখিরা উড়ে গেলেও বাচ্চারা অনেকেই ঝাকবেঁধে বসে থাকে, বিপদ। বােঝে না। এই না বােঝার কারণেই বাচ্চারা বিপদে পড়ে বেশি। ১৯৭৫ সালের বােশেখ মাসে আমি আমার গ্রামের ওপর দিয়ে প্রায় দু'হাজার শামুকভাঙ্গার একটি ঝাককে উড়ে যেতে দেখেছিলাম। লেখার শুরুতে যে বর্ণনা আমি দিয়েছি, সেটা আমার গ্রামের সাল ছিল ১৯৬৪।

শামকভাঙ্গা বর্তমান বাংলাদেশেও বেশ আছে। সুন্দরবন, সিলেট, চট্টগ্রামসহ প্রায় সারাদেশেই দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কমে গেছে অনেক। বড় বড় ঝাক নজরে পড়ে না সহজে। বাসা বাঁধার গাছের বা খাবারের অভাব নেই। আছে নিরাপত্তার অভাব। তবে, গত ৩/৪ বছর যাবৎ শামুকভাঙ্গাদের সংখ্যা ও নিরাপত্তা বেশ বেড়েছে। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার পচামাড়িয়া গ্রামে ও পিরােজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার হেতালিয়া গ্রামে বড় সড় কলােনি আছে ওদের এই ২০০৮ সালেও। সর্বশেষ একটি বড় ঝাক দেখি ফেনী জেলার ত্রিপুরা সীমান্তে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url