বাংলাদেশের পাখি : সাপ পাখি

এই পাখিটির নাম হচ্ছে সাপ পাখি। গয়ারও বলা হয়। ইংরেজি নাম স্নেকবার্ড। বৈজ্ঞানিক নাম Anninga melanogaster । ইংরেজি আরেকটি নাম হচ্ছে Darter ঠোটের আগা থেকে পিঠ হয়ে লেজের ডগা পর্যন্ত মাপ হচ্ছে ৯৮ সেন্টিমিটার (পুরুষ), ৯২ সেন্টিমিটার (মেয়ে)।

বিলের কিনারা জুড়ে সারি সারি হিজলগাছ। মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়, অনেক বাশ ঝুকে আছে বিলের দিকে। ওরকমই একটা বাঁশ থেকে শুকনাে কঞ্চি। ভাঙার চেষ্টা করছে একটি পানকৌড়ি। ওর থেকে অল্প দূরে, বিলের কিনারে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বয়সী বরইগছি। ওই গাছে ডাকাডাকি করছে ছয়টি পানকৌড়ি, বাসা বাঁধার কাজে মহাব্যস্ত ওর।

এত যে ডাকাডাকি, তবুও অন্য একখানা ডালের বাসায় বসে নির্বিকারভাবে ডিমে তা দিচ্ছে একটি ছােট্ট সবুজ বক। বরই গাছটার গােড়ার ঝােপে বাচ্চা-বুকে বসে আছে একটি নলঘোঙা পাখি । পুরুষ পাখিটিও রয়েছে কাছাকাছি, মাটিতে। এই এলাকায় তাই অনেক পাখি। ওখানেই খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ডাহুক ও ছানাসহ একটি বড় হলতি। ঝরা বাঁশপাতার ওপরে। বসে ঘুমাচ্ছে ছ'টি দিনেকানা। এলাকাটা নির্জন।

জনবসতি অনেক দূরে। ওইতাে—যে বাঁ পাশটায় তিনটি জলডুবুরি পাখি, একজোড়া কোড়া তাদের। বড় বড় পাঁচটি বাচ্চা নিয়ে চরছে হােগলাবনের পাশে। শাপলাবনে চরছে দশটি বালিহাঁস। কলমিদামের ওপরে দাঁড়িয়ে পালক ধােয়ামোছা করছে দু'টি জলপিপি। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক ঝাড় গােলপাতার গাছ।

ওগুলাে সুন্দরবন থেকে এনে ওখানে লাগিয়েছিল এক বাওয়ালি। ওরই একটার ওপর পাশাপাশি বসে রােদ পােহাচ্ছে একজোড়া পাখি । সাপের মতাে সরু গলা ও মাথা রেখেছে টানটান করে। শরীর দেখা না গেলে ও দু'টিকে অবিকল সাপ বলেই মনে হত। একটু আগেও টুপটুপ ডুব দিয়ে মাছ
চ্ছিল, এখন একে তাে বিলের ভাল টলমল, তার ওপর সকাল । শাপলা কলমিদামের ফাকে ফাকে তাে বটেই, ফাঁকা জায়গাগুলাের জলের তলার শেওলা ও মাটি পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওই দু'টি পাখি যখন ডুব দিচ্ছিল, জলের তলায়ও ওদের পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। টলটলে জলে আকাশ আর গাছগুলোর ছায়া মায়াময় একটা অৰিহ সৃষ্টি করে রেখেছে।

শুকনাে কঞ্চি-মুখে জলের ওপরে ছবি আঁকতে আঁকতে সেই পানকৌড়িটি এল বরই গাছে। বউ ওর মুখ থেকে কঞ্চিখানা নিল, সাজাতে লাগল বাসা। বাসাটি ওরা শুরু করেছিল গতকাল দুপুরে । ডালপালা বেশি তাই জমে নি। অন্য বাসাগুলাের কোনােটা প্রায় শেষ, কোনােটার অর্ধেক হয়েছে। গােলপাতায় বসা পাখি দু'টি ঝট করে উড়ল, উঠে পড়ল অনেক ওপরে, ওদের বুক-পেটের কালাে রঙ যেমন জ্বলে উঠল রােদে, তেমনি ডানার পালকের চকচকে রূপালি-সাদা রঙটাও ঝলকালাে। ওড়ার ভঙ্গিটাও চমৎকার।

টানটান লম্বা গলাটি। পেছনের দিকে পা দুটি টানটান। ওরা কয়েক পাক ঘুরল বরইগাছটার মাথার ওপর দিয়ে, তারপর নিচে নেমে বরই গাছটার ওপরেই পাক খেতে লাগল, ডাক ছাড়তে লাগল, বারবার লম্বা গলাটি সাপের মতােই বাড়িয়ে দিতে লাগল নিচের দিকে। পানকৌড়িগুলাে বুঝে ফেলল, মতলব ভালাে নয় ওদের। তাই সবাই মিলে গলাটা ওপর দিকে বাড়িয়ে উড়ন্ত পাখি দুটিকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য চেঁচামেচি করতে লাগল। ডিমে বসা বকটি ব্যাপারটির দিকে সতর্ক নজর রাখছে। উড়ন্ত পাখি দুটি সেই ডালের পাশেই বসল, যে ডালে একটু আগে শুকনাে কঞ্চি নিয়ে এসেছে একটি পানকৌড়ি, বউটি তখনো বাসা সাজাচ্ছে। বসেই পাখি দু'টি ভয়ঙ্কর-সুন্দর ভঙ্গিতে একেবারে সাপের মতাে ফণা তুলল যেন, চাপাস্বরে ডাক ছেড়ে ফণা নাচাতে লাগল।

সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! পানকৌড়িরাও রুখে দাঁড়িয়েছে একযােগে, লাগিয়েছে বেজায় শােরগােল। কিন্তু ওই পাখি দু'টিও নাছােড়বান্দা, ডানা মেলে সেগুলাে ঝাকাতে লাগল। এ হচ্ছে ভয় দেখাবার কৌশল, সাপের ফণার মতাে লম্বা সরু গলা-মাথা দোলাচ্ছে, এপাশ-ওপাশ করছে ছােবল দেবার ভঙ্গিতে। পানকৌড়িগুলােও ঠোট ফাক করে ভয় দেখাচ্ছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে। এ সময়ে আচমকা একটি পাখি ঠিক সাপের মতাে ছােবল মারল একটি পানকৌড়িকে, ভয়ার্ত ডাক ছেড়ে সে পিছিয়ে গেল। ও হচ্ছে পানকৌড়ির সেই বউটি, যে একটু আগে পুরুষ-পাখির মুখ থেকে শুকনাে কঞ্চি নিয়েছিল। এবার পুরুষ পাখিটি রুখে দাড়াল, কয়েক সেকেণ্ড ঠোটে ঠোটে ঠোকাঠুকি করে সেও সরে গেল।

অন্য পানকৌড়িরা আর ঘাটাতে এল না পাখি দুটিকে। এবার পাখি দু'টি চরম আক্রোশে তছনছ করল গতকাল শুরু-করা পানকৌড়ির বাসাটি। ফেলে দিল সব খড়কুটো। তারপর খুশি হয়ে দু’জনে উড়ে গিয়ে বসল সেই গোলপাতা গাছে। শুকনাে দুটি পাতা মুখে টেনে ছিড়ে নিয়ে ফিরল 'আবার বরইগাছে। দখল করা জায়গায় ওরা বাসার ভিত তৈরি করে ফেলল। উচ্ছেদ হওয়া পানকৌড়ি দু'টি তাকিয়ে রইল অসহায়ভাবে। বাছতে লাগল অন্য ডাল, যেখানে তারা আবার শুরু করবে বাসা বাধার কাজ। অন্য পানকৌড়িগুলােও বিপদ কেটে গেছে ভেবে যার যার বাসার দিকে নজর দিল। এই যে পাখি দুটি, পানকৌড়িদের আচার-আচরণের সঙ্গে এদের অনেক মিল আছে। এক জায়গাতেই চরে, ঝগড়াঝাঁটি লাগে না।

একই গাছে পাশাপাশি বাসাও বানায়। মিলেমিশে থাকে। অথচ আজ কেন পাখি দুটি পানকৌড়ির বাসার জায়গা দখল করল? এ প্রশ্নের জবাব গভীর ও দীর্ঘ। পর্যবেক্ষণ ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। আমি এই পাখিদের আচার-আচরণ ভালোভাবে লক্ষ্য করার সুযােগ পেয়েছি। বাসাও দেখেছি বহুবার। বাসা বানাতেও দেখেছি। বাল্যকৈশােরে বাসা থেকে ডিম চুরি করে খেয়েছি। আবার মুরগি ও পােষা কবুতরের পেটের তলায় ডিম ফোটাতে চেষ্টা করেছি, ফোটে নি, নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা এনে পােষ মানাতে চেষ্টা করেছি।

পােষ মানে নি, না-খেয়ে মারা গেছে। আমি পানকৌড়ির ডিমের সঙ্গে ওদের ডিম বদল করে দেখেছি যে, ডিম ফোটে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ওরা বুঝে ফেলে যে বাচ্চাটি তার নয়, খাওয়ায় না। পরিণামে বাচ্চা মারা যায়। পাশাপাশি, ওই বাচ্চা বদল করেও দেখেছি খাওয়ায় না, অথচ যার ডিম, যার ডিমের বাচ্চা, তাকেই তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভেবেছে পরের বাচ্চা। অথচ পানকৌড়ি ও এই সাপ-গলা পাখিরা কিন্তু একে অন্যের বাচ্চাকেও খাওয়ায়।

বন্দুক হাতে বিল-ঝিল-জলাশয়ের কিনারের গাছে বসে আমি বহুবার টলটলে জলের তলায় এই সাপ-গলা পাখিদের গতিবিধি দেখেছি। জলের তলা দিয়ে যখন ওরা এগোয়, শরীর-গলা-মাথা একটা সরল রেখা হয়ে যায়, মনে হয় একটি সাপ সরল রেখা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সে এক মুগ্ধ হবার মতাে দৃশ্য। জলের তলায় এরা থাকতে পারে এক নাগাড়ে তিন মিনিট। তবে ভয় না পেলে বা বন্দুকের গুলি খেয়ে ডুব না দিলে দেড় মিনিটের বেশি। থাকে না। ওই দৃশ্য দেখে আমার নেশা ধরে গিয়েছিল ছেলেবেলায়। তাই শুধু দেখার জন্যও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছে বসে থেকেছি। দেখেছি পানকৌড়ির চলাফেরাও। কয়েকটি সাপ-গলা পাখি যখন জলের তলায় ঘােরে তখন বিস্মিত হতে হয়।

মাছের দিকে যখন তেড়ে যায়, মনে হয় টর্পেডাে বা তীরের ফলা ছুটছে। মাছ একটু বড় হলে ওরা মাছের শরীরে ধারালাে ঠোটটি তীরের ফলার মতােই ঢুকিয়ে দেয়, মাছটি হয়ে যায় এফোঁড়-ওড়ে , আর পাখিটি তখন ভেসে ওঠে জলের ওপর। বন্ধ ঠোট ফাক করে, তাতে মাছের শরীর কেটে যায় ছুরির টানের মতাে। এক আশ্চর্য কৌশল এই পাখিদের। ঠোট আবার বন্ধ করে। তারপর অপূর্ব কৌশলে গলা-মাথা উচু করে মাছ ছুড়ে দেয় ওপর দিকে, আশ্চর্য! ঠোট ওই চিরে যাওয়া অংশের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়, মাছটি চলে আসে ঠোটের গােড়ায়।

তখনাে মাছটি না মরে থাকলে ঠোটটা ঘােরাতে থাকে, ঘুরতে থাকে মাই। মারা যাবার পরে মাছটি আবার ঠোঁটের আগায় আনে, ছুড়ে দেয় শূন্যে, তারপর মুখে পােরে। মাছ ছােট হলে চেপে ধরে ঠোটের ফাকে। একই কায়দায় শূন্যে ছুড়ে দিয়ে টুকুস করে গিলে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যর্থ হয় অনেক সময়। মাছটি মুখে পড়ে জলে পড়ে যায়। আবার আমি দেখেছি যে, ভয় পেলে বা সন্দেহ হলে ওরা ডুব দেয়, যতক্ষণ পারে, থাকে জলের তলায়, তারপর কোনাে জলজ উদ্ভিদ বা শাপলা-কলমির মাঝে সাবধানে শুধু নাকসহ ঠোটটি জাগিয়ে থাকে।

সে ক্ষেত্রে দেখলে সাপ বলেই ভ্রম হবে। এই পাখির জাগানাে মাথা দেখে সাপ ভেবে ভয় আমিও পেয়েছি। বাল্যকালে প্রথম যেবার পানকৌড়ির বাসা ভেবে হাত দিয়েছিলাম একটি সাপ-গলা পাখির বাসায়, আমার জান হাতের পিঠের নরম চামড়ায় ঠোকর দিয়েছিল একটি ছানা, হাত টানতেই ওর গলাটিও নেমে এসেছিল। সেদিন আমি দাড়াস সাপ ভেবেছিলাম ওকে।

ভেবেছিলাম বাসার ডিম বা বাচ্চা খেয়ে সাপটি বাসাতেই ছিল। আমার হাত বাধা হয়েছিল। সাপের ওঝা এসেছিল। পরে অবশ্য ভুল ভেঙেছিল। হ্যা, এদের বাসা থেকে ডিম-বাচ্চা চুরি করে খায় ঈগল-বাজ-চিলরা, গুইসাপ আর ডিমখেকো সাপেরাও। রাতে খায় ভুতুমপেঁচারা। মানুষের নজরে পড়লে তো কথাই নেই।

বাংলাদেশের পাখি : সাপ পাখি

এবার দেখা যাক, ওই দুটি পাখি কেন পানকৌড়িদের বাসা দখল করল। সম্ভাব্য কারণটি হচ্ছে, এই জায়গাটি ওরা আগেভাগেই পছন্দ করে রেখেছিল। তবে ওদেরকে আমি কানিবক, ডাহুক আর পানকৌড়ির তৈরি বাসাও দখল করতে দেখেছি। পরের বাসা দখলের প্রবণতা এদের রয়েছে। নিজের দখল ঠিক থাকলে, একেবারে পাশেই বক বা পানকৌড়িতে বাস করলেও আপত্তি করে না ওরা। অকারণে ঝগড়া-ফ্যাসাদও বাধায় না।

এদের বাচ্চারা একটু বড় হলে বাসার তলায় গিয়ে হাততালি দিলে ভয়ে বাসা থেকে লাফিয়ে পড়ে। এই সুযােগটা কাজে লাগায় বনবিড়ালরা। ওরা গাছতলায় গিয়ে জোরে ডাক ছাড়ে আর বাচ্চারা তখন লাফ দেয়। বনবিড়াল ওদেরকে খায়। রাতে গাছে চড়েও শিকার করে। অন্তত দুবার আমি বনবিড়ালকে এই কৌশল কাজে লাগাতে দেখেছি। সাপ-গলা এই পাখিটির নাম হচ্ছে সাপপাখি। সার্থক নাম। গয়ারও বলা হয়। ইংরেজি নাম স্নেক-বার্ড।

 বৈজ্ঞানিক নাম Anhinga melanogaster। ইংরেজি আরেকটি নাম হচ্ছে Darter। ঠোটের আগা থেকে পিঠ হয়ে লেজের ডগা পর্যন্ত মাপ হচ্ছে ৯৮ সেন্টিমিটার (পুরুষ), ৯২ সেন্টিমিটার (মেয়ে)। শুধু গলা-ঠোটের মাপ হচ্ছে পুরাে শরীরের একতৃতীয়াংশ। ঠোট, গলা, পাখা, পা ইত্যাদির আলাদা আলাদা মাপ আমার। ব্যক্তিগত পাখি বিষয়ক ডায়রিতে ২৩ জায়গায় আছে। অর্থাৎ ২৩ বার আমি নিজে পাখিটির মাপ ও ওজন নিয়েছি। শীতকালে ডানা মেলে ওরা যখন। রােদ পােহায়, অন্য সময় যখন এভাবে শরীর শুকায়, যখন গলা-মাথা টানটান করে, তখন দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মনে হয় শিল্পীর আঁকা সুন্দর কোনাে ছবি দেখছি।

সাপপাখির গলা সরু, গােলাকার ও লম্বা, মাথা ছােট। ঠোট সােজা ও চোখা। ঠোট ও পা হলুদ। পায়ের আঙুল চারটি, অনেকটা হাঁসের পায়ের মতাে দেখায়। চোখের পাশ থেকে হলদেটে সাদা একটা টান এসেছে ঘাড়ের দিকে। মাথা-ঘাড়-গলা লালচে-বাদামি। সাদা খাড়া একটা টানও আছে। পাখার মূল পালকগুলােও কালাে। উজ্জ্বল-মায়াবি চোখ। ঋতুভেদে রঙ অতি সামান্য বদলায়। গলার তলাটা বাদামি-সাদা।

সাপপাখি রঙচঙা না হলেও দেখতে খুবই সুন্দর। এরা চমৎকার ডাইভ মারতে পারে জলে, সাপের মতাে ছােবল দিয়ে মাছ ধরতে পারে। দক্ষ ডুবুরি । উড়তেও পটু। গুলি খাওয়া আহত পাখিকে আমি খাড়া এত ওপরে উঠতে দেখেছি যে, অবাক না হয়ে পারি নি। আহত পাখিকে অল্প জলে তাড়িয়ে ধরতে গিয়ে বুঝেছি কতটা চালাক এরা।

এরা জলের পাখি। খায় ছােট ও মাঝারি মাছ, ছােট ব্যাঙ, ছােট শামুক, জলফড়িং ও জলজ উদ্ভিদের নরম 'ডগা। সুযােগ পেলে জলসাপ ও ঢেড়সাপের ছােট বাচ্চাও গেলে।
শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণের মধ্যে এরা বাসা বাঁধে। তবে শীতকালেও বাসা বানায়। আমার বিচারে শীতকালে বাসা কম করে। দুজনে মিলে বাসার জায়গা খুঁজতে লাগায় ২-৩ দিন।

তবে, একই গাছের একই ডালে একজোড়া পাখিকে আমি পরপর তিন বছর বাসা বানাতে দেখেছি। বাসার উপকরণ শুকনাে বা কাচা ডাল-পাতা, হোগলাপাতা, ধানের নাড়া ইত্যাদি। কাকের বাসার চেয়েও অগােছাল, গভীরতায়ও কম। দুজনে বাসাটি শেষ করে ৪-৭ দিনে। ডিম পাড়ে অধিকাংশ সময় ৫টি। ৬ ও ৩ এর সংখ্যা কম। শুধু ২টি ডিম পাড়ে। ডিম চুরি গেলে ২০/২৫ দিন পরে আবারাে ডিম পাড়ে। সেক্ষেত্রে ডিমের সংখ্যা যায় কমে। দ্বিতীয়বার ডিম চুরি গেলে আর পাড়ে না। ডিমের রঙ ঘােলাটে সাদা, তাতে নীলচে আভা। ডিম লম্বাটে, মােটা মাথায় সবুজ ও নীলচে ছােপ।

দু'জনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ২৬ দিনে। আমি দশবার ২৬ দিনে ডিম ফুটতে দেখেছি। তিনবার দেখেছি ২৯ দিনে ফুটতে। বাচ্চারা অন্ধ থাকে, দেখতে কাঁচা মাংসপিণ্ডের মতাে। ৬ দিন পর শরীরে লােম গজাতে শুরু করে, ১২ দিনে সব লােম গজিয়ে যায়। এ সময় দেখতে লালচে-বাদামি। উড়তে শেখে ৪৫ দিনে। খাবার জন্য মা-বাবাকে বড় বিরক্ত করে। বাসায় থাকতে নিজেদের ভেতর মারামারি লাগায়।

বাড়ন্ত বাচ্চারা বাসায় বসে মারামারি বাধালে মনে হয় যে, সাপের লড়াই লেগেছে। ও সময় চাপা ফোস-ফেঁাস আওয়াজও করে। এমনিতে সাপপাখির গলার স্বর কর্কশ ডিগী ডিগী বা ডিগ্রী-ড্র ধরনের। মা ও বাবা পাখি গলাভরে মাছ আনে বাসায়, উগরে দেয় বাচ্চাদের সামনে। আবারাে যায় খাবার আনতে। এ সুযােগে অনেক সময় শঙ্খচিলেরা ছোঁ মেরে মাছ ছিনতাই করে, বাচ্চারা ছােট থাকলে বাচ্চাও তুলে নেয়। বাচ্চার কান্নায় তেড়ে আসে মা-বাবা, করে ধাওয়া ।

ছেলেবেলায় যে পাখিটিকে বহুবার দেখেছি, এখন অনেক খুঁজেও সেই পাখিটিকে পাই না। চোখের সীমানায় ওরা নেই। তাই চোখের সীমানার বাইরে গিয়ে খুঁজি। যারা ঢাকায় আছে তারা ইচ্ছে করলে ঢাকা চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখে আসতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনাে কখনাে। দেখা যায়।

আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে সাপপাখি। ছিল, এখন নেই। আগামী ৩০ বছর পরে হয়তো একটিও না থাকতে পারে । এমন সুন্দর ও উপকারী একটি পাখি বাংলাদেশ থেকে যেন হারিয়ে না যায়। সেই চেষ্টা আজ বড়ই জরুরি।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url