বাংলাদেশের পাখি : দোয়েল

দোয়েল বাংলাদেশের পাখি : দোয়েল
বাংলাদেশের পাখি : দোয়েল

চারপাশে বাঁশবন, মাঝখানে ঘাসবন। কাশফুলের মতাে ফুটে আছে ঘাসফুল, জ্যৈষ্ঠের হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে কী চমৎকার ! দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাদা কার্পেট, সেই কার্পেটে ঢেউ জাগছে বার বার।

ওই সাদা ঢেউয়ের চূড়ােয় পা ফেলে-ফেলে, বেশ ভীতু ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে একটি খেকশিয়ালের বাচ্চা। কাশফুলের মতাে লেজ ওর, উঁচু করে রেখেছে। কাচের মার্বেলের মতাে চোখ, মা বাসায় নেই। গর্ত ছেড়ে একাকী। বেরিয়ে পড়েছে।

ঘাস বনের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে একটি মরা সােনালু গাছ। বাচ্চাটি এগােচ্ছে ওদিকেই। এগােনাের কারণও ঘটেছে। সাদা-কালাে এক পাখি ওই গাছের গােড়ায় বার বার নামছে। বাচ্চাটি তাই কৌতুহলী হয়ে উঠেছে।

গাছের কাণ্ডে একটা ফোকর, মাটি থেকে ৪০ সেমি, ওপরে। ওই ফেঁকরে। পাখির বাচ্চা ডাকছে— “হিহিহি...হিহি..সিই-ই হি হি.। খেকশিয়ালের বাচ্চা বেশ সতর্ক এখন, চোখে ওর রাজ্যের বিস্ময় ! ও বুঝতে পারছে না কারা শব্দ করছে ওই ফোকরের ভেতরে বসে। অনেক সাহস করে ও পেছনের দু'পায়ের ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াল, সামনের দু পা ঠেকিয়ে দিল গাছের কাণ্ডে। সঙ্গেসঙ্গে ঘটে গেল ভয়ঙ্কর এক কাণ্ড। সাদা-কালাে সেই পাখি বাঁশবনের ভেতর দিয়ে উড়ে এল সাঁই করে, আচমকা আক্রান্ত হয়ে বাচ্চাটি চিৎপটাং। তারপর বো-কাট্টা। ঘাসফুলের মাথা ছুঁয়ে তেড়ে গেল সাদা-কালাে পাখি, বারকয়েক ডাইভ দিল শত্রুর মাথার ওপরে। মাটির গর্তে ঢুকে তবেই না রক্ষে। ফিরে এল পাখি। সােনালু গাছের ফোকরে উঁকি দিয়ে দেখল বাচ্চারা ঠিকঠাক মতন আছে কিনা। তারপরে ফুড়ুৎ করে আবার বাঁশবনের দিকে চলে গেল।

এই সাদা-কালাে পাখিটি বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক পাখি। বুক ভরা ওর সাহস, চোখ ভরা স্বাধীনতা। ওর চালচলনে আছে আভিজাত্যের ছাপ। বাংলাদেশের এমন কোনাে শহর বা গ্রাম নেই, যেখানে দোয়েল নেই, ভােরবেলায় দোয়েলের প্রাণ মাতানাে শিস কিংবা গান নেই। সে আছে সিলেট-চট্টগ্রামের পাহাড়-টিলায়। সে আছে সুন্দরবনে। সে আছে রাজধানী ঢাকা শহরে। এই শহরের দর-দালানের ফঁাকফোকরে, ভেন্টিলেটরে বাসা করে সে। বাচ্চা তােলে। কাঠ বা পিসবাের্ডের বাক্স, মাটির হাঁড়ি-কলসি যদি বারান্দার কোণে বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলেও বাসা করতে পারে ওরা। বাসা বাঁধার পছন্দসই জায়গা নির্বাচনে ব্যয় করে ২ থেকে ৪ দিন। এই পছন্দের ব্যাপারে ওদের কিছু একগুয়েমি রয়েছে। ওরা চড়ুই, আবাবিল, বসন্তবৌরি, কাঠঠোকরা, টিয়াদের বাসাও পছন্দ করে ফেলে অনেক সময়। ওই পছন্দই চূড়ান্ত। অথচ, ওই বাসায় হয়তাে রয়েছে। উল্লিখিত পাখিদের ডিম-বাচ্চা। পুরুষ-দোয়েল বাসা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বার বার হানা দেয়, লড়াই করে। যদিও লড়াইটা সে এড়িয়ে চলতে চায় কৌশলে। সুযােগ মতাে ঢুকে পড়ে বাসার ভেতরে, ডিম নষ্ট করে, বাসা তছনছ করে, বাচ্চা ঠোটে ধরে বাইরে ফেলে দেয়। কখনাে কখনাে বাচ্চাদের মেরেও ফেলে।

বাসা দখলের জন্য পুরুষ-দোয়েল ৭ দিনও অপেক্ষা করে থাকতে পারে। উল্লিখিত পাখিরা ভয়ে বাসা ছেড়ে দিতে পারে, লড়াই করতে এসে হেরে যেতে পারে, অতিষ্ঠ হয়েও বাসা ছেড়ে দিয়ে দূরে চলে যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোয়েল পছন্দের বাসাটিকে কজা করে নেয়। নাছােড়বান্দা সে এক্ষেত্রে। তবে টিয়েদের সঙ্গে সব সময় এঁটে উঠতে পারে না। পরের বাসা দখলের প্রবণতা দোয়েলের যেমন আছে, বাংলাদেশের অন্য কোনাে পাখির বেলায় তা কম দেখা যায়। উৎসাহী হলে এই রাজধানী শহরেই আবাবিল ও চড়ুইয়ের বাসা দখলের ক্ষেত্রে দোয়েলের ভূমিকা দেখতে পারে যে কেউ। বাক্স, হাঁড়ি, পাতিল টানিয়ে দোয়েলকে টেনে আনাও সম্ভব এই রাজধানী শহরে।

দোয়েলের বাসা বাঁধতে সময় লাগে ২ থেকে ৫ দিন। বাসা শেষ হলেই প্রথম ডিমটি পাড়বে। ৩ দিনের ভেতরে ৪টি ডিম দেখা যাবে বাসায়। ১৪ দিন পরে প্রথম ডিমটি ফুটবে। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার ভেতরে বাকি ৩টি ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুবে। ন্যাংটো বাচ্চাগুলােকে মনে হবে কাঁচা মাংসপিণ্ড। কেউ যদি ১০০ দোয়েলের বাসা পর্যবেক্ষণ করতে পারে, তাহলে ওর ভেতরে বড়জোর ৭টি বাসায় ৩ অথবা ৫টি ডিম দেখবে সে, ৯৩টি বাসায় ৪টি করে ডিম দেখবে। অর্থাৎ, দোয়েল অধিকাংশ সময় ৪টি ডিম পাড়ে। আবার এই যে ৪টি ডিম, ৫৭ ভাগ ক্ষেত্রে ৩টি ডিম থেকে বাচ্চা হয়, ১টি ডিম নষ্ট হয়।

দোয়েলের ডিমের রঙ নীলচে, তার ওপরে অতি সূক্ষ লালচে আভা। থাকে। লালচে আভার আড়ালে আবার হাল্কা সবুজাভ ভাব থাকে। লালচে আভার ওপরে ঘন লালচে-বাদামি ছিট ও ছােপ থাকে। বাসায় যদি রােদ পড়ে, ডিমের রঙ বেশ ফ্যাকাশে লাগে। অন্ধকার বাগানের বাসায় ডিমের। রঙ কিছুটা ঘন হয়। বৃষ্টিভেজা ডিমের আবার রঙ খােলে। ডিম লম্বায় হয়। ২.৫ সেমি.। চওড়ায় প্রায় ১.৫ সেমি.। টিকটিকির ডিমের চেয়ে ৬ গুণ বড়।

যেহেতু দোয়েল আমাদের খুব চেনা পাখি, কাছের পাখি, কাজেই পুরুষদোয়েল ডিমে তা দেয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে যে কেউ। বাচ্চারা বাসা ছাড়ে ১৪-১৫ দিন পরে। বাচ্চারা স্বাবলম্বী হলে দোয়েল দম্পতি দূরে। কোথাও চলে যায়। বাচ্চারা থেকে যায় চেনা-জানা পরিবেশে। তারপর বাসা করে। বাসা করার পরে ওদের বাবাও যদি ভুলক্রমে এসে পড়ে এই এলাকায়, ছেলে তেড়ে যায় বাবার দিকে, বাবাকে এলাকা ছাড়া করে। ও তখন বাবামাকে চেনে না, বাবা-মাও এই সেদিনের আদরের বাচ্চাদের চেনে না। যে বাচ্চা আজ তাকে তাড়া করল, এই তাে সেইদিনও ওরা কত ছােট ছিল ! বাবা-মা দুজনেই বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে পরম আদরে। বাচ্চাদের নিরাপত্তা বিধান করেছে কঠোরভাবে। উড়তে শেখার পর বাচ্চাদের এলাকা চিনিয়েছে। শত্রু-মিত্র চিনিয়েছে, চিনিয়েছে খাদ্য। তারপর নিজেরই কঙ্কা করা এলাকা বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছে দূরে। কেননা, দোয়েলেরা নিজেদের একটি এলাকা কজায় রাখে। এলাকাটা কমপক্ষে ১০০০ বর্গমিটার হয়। নিজের এলাকায় অন্য কোনাে পুরুষ-দোয়েল এলেই এই এলাকার পুরুষদোয়েল তাকে হটিয়ে দেয়। মানুষের চোখে বাবাকে তাড়িয়ে দেওয়া দুঃখজনক মনে হলেও পাখির রাজ্যে ওটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতিরই বিধান।

দোয়েল সাহসী পাখি, বুদ্ধিমানও সে। তবুও বাসা বাঁধার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই সে বােকামির পরিচয় দেয়। সব সময় মানুষ চলাচল করছে, এমন জায়গায়ও বাসা করে। একটি মানবশিশুর হাতের নাগালে, একটি বন্যপ্রাণীর থাবার নাগালে, একটি শিকারি পাখির নখের নাগালে প্রায়ই বাসা করে ওরা। করে বলেই ডিম-বাচ্চা প্রায়ই ছিনতাই হয়। অল্পদিনের ব্যবধানে দোয়েল একই বাসায় আবারও ডিম-বাচ্চা তুলতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ডিম ৩টির। বেশি হবে না। এমনই বােকা পাখি ওরা, যে বাসা থেকে ডিম-বাচ্চা ছিনতাই হয়েছে, সে বাসাতেই ওরা আবারও ডিম-বাচ্চা তুলতে চায় ! শুধু কি তাই? বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচনে ওদের কোনাে বাছ-বিচার নেই। এক্ষেত্রে বােকার। হদ্দ ওরা। খাড়া করে রাখা বাঁশের মাথার গর্তে, সুপারি গাছের মাথার গতে, কুটোর পালার মাঝের বাঁশের গর্তেও বাসা করে ওরা। বৃষ্টি হলেই জল জমে যেতে পারে বাসায়, নষ্ট হতে পারে ডিম, মরতে পারে বাচ্চা। আবার লবণের পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত লাউয়ের খােলের ভেতরেও বাসা করে। বাসা করে কাঁঠাল গাছের ডালে রাখা গরুর করােটির ভেতরে। আমি নিজেও এক পরিত্যক্ত বাড়ির রান্নাঘরের চুলাের পাশে ঝুলিয়ে রাখা লাউয়ের খােলের ভেতরে ২টি দোয়েলের বাচ্চা দেখেছিলাম।

বাংলাদেশের যেসব পাখি বাসা বাঁধার গান গায়, আশেপাশের সব পাখিকে বাসা বাঁধার খবর জানায়, ডিম-বাচ্চা হবার সংবাদও জানায় ফুর্তিতে গান গেয়ে গেয়ে, দোয়েল তাদের মধ্যে অন্যতম। কমবেশি এক যুগ বাঁচে ওরা। হিসাব করলে তার ভেতরে ৩ বছর গান গায় ওরা। অর্থাৎ দিনের অধিকাংশ সময়েই গান গেয়ে কাটায়। শীত-গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা-শরৎ নেই। গান সে গাইবেই। বাসা বাঁধার গান সে শুরু করে শীত মৌসুমে। শীতেই সে বুঝে ফেলে সামনে বসন্ত, বাসা বাঁধতে হবে। শীত না ফুরােতেই বাসা করে কেউ কেউ। বসন্তে বাসা বেশি হয়। ভাদ্র পর্যন্ত দোয়েলের বাসা দেখা যায়। এক বছরে কেউ কেউ ৩ বারও বাচ্চা তােলে। যদিও দালানের ফঁক-ফোকর কিংবা ঘুলঘুলিসহ ইটের পাঁজার গর্তে, গাছের কোটরে, এমনকি ফেলে দেওয়া হাঁড়ি-কলসির ভেতরেও বাসা করে ওরা। বাসা করে বেশ ছিমছাম। যেরকম বাসা করে, তাতে গাছের ডালেও বাসা দাঁড়াতে পারে। কিন্তু গাছের ডালে বাসা করে
। বাসা আবার হয় জায়গা বুঝে। অর্থাৎ গর্তের ভেতরে জায়গা বেশি হলে বাসা বড় হয়। ছােট হলে ছােট। বাসা তাই বাটির মতাে হতে পারে, চায়ের কাপের মতাে হতে পারে, আবার ঘুঘুর বাসার মতাে আগােছালােও হতে পারে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তবে স্বাভাবিক বাসার মুখের ব্যস ১০-১৭ সেমি.।। গভীরতা ৫-১০ সেমি.। বাসার উপকরণ হচ্ছে, যে কোনাে গাছের অত্যন্ত। সরু ডাল, মানুষের চুল, গবাদি পশুর পশম ও লেজের লােম, শুকনাে। দূর্বাঘাস, খড়, উলুঘাস, সাপের খােলস, চুলের ফিতা, ধানের শুকনাে কুটো, গাছের সরু সরু শিকড়-বাকড়, পাটের আঁশ, কলাগাছের শুকনাে আঁশ ইত্যাদি। কিশাের বয়সে আমি একবার বাবুইয়ের বাসা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম ঘরের পেছনে। বাসার গায়ে ছিল বড় ছিদ্র। ওর ভেতরে এক জোড়া দোয়েল বাসা করেছিল।

দোয়েল বিশ্বের অন্যতম সেরা গায়ক পাখি। বিশ্বের নামকরা গাইয়ে। পাখি রবিন ও নাইটিঙ্গেলের চেয়ে সে কিন্তু কম ভাল গায় না। রবিন হচ্ছে। ১৪ সেমি, লম্বা এক সুন্দর পাখি। নাইটিঙ্গেল ১৬ সেমি. । রবিনের রঙ বসন্তকালে খােলে, শীতে একটু ম্লান হয়। ওদের ডানায় যেন বিচিত্র রঙের খেলা। লেজ খাটো ঠোট লম্বাটে। পা লম্বা। লালচে কমলা বুক। মুখও তাই। পিঠের ওপর খাকি রঙ। পেট সাদা। দূর থেকে নীলচে ছাই মনে হয়।

ইউরােপসহ রাশিয়া, সাইবেরিয়া ও ইরানের দক্ষিণের এই গাইয়ে পাখির । গানের ভাষা হচ্ছে ‘টিক্ টিক’ ধরনের। তবে তাতে বােল-চাল আছে, তাল আছে, আছে মিষ্টতা। সুরের অনুরণন আছে। আর নাইটিঙ্গেলের কণ্ঠস্বর হচ্ছে ‘পিউ পিউ পিউ....'। তবে এই স্বর ছড়িয়ে পড়ে অনেকটা ঘড়ির অ্যালার্মের মতাে। আবার ‘কুইক টুররা’ সুরেও গান গায় সে। পাশাপাশি আমাদের দোয়েলের কণ্ঠস্বর হচ্ছে বিচিত্র ধরনের। মনের আনন্দে, আত্মভােলা। হয়ে খুব ভােরে কোনাে উঁচু জায়গায় বসে যখন সে গায়, তখন তার সুর হচ্ছে—‘সুইট-ই, সিট, সিই-ই ইউ...টিট... টিট, সিস, সুই-ইইইট...ছিপ ছি ছির...সি সি সিইউ...সিট...ছিপ...সুইস-স্ স্ স্।

কী যে মােলায়েম আর সুরেলা ওর গলা ! খুব ভােরে এক জায়গায় বসে গান সে গাইবেই। মাথা থাকবে কিছুটা উঁচু, গলা নাচবে, লেজ দুলবে, ডানা থাকবে কিছুটা প্রসারিত। ভাের সাড়ে চারটা থেকে গান শুরু করতে পারে, একটানা এক জায়গায় বসে এক ঘণ্টাও গান গেয়ে চলে সে। শান্ত ভােরে তার গান ছড়িয়ে পড়ে ৪ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে। গায়কী ঢংটাও দেখার মতাে। পাশাপাশি বাসা বাঁধার গান, ডিম-বাচ্চা হবার আনন্দের গানের সুর একটু ভিন্ন রকম হয়। তখন ওর গলা উপচে যেন সুরের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ফুর্তি গড়িয়ে পড়ে ওর ঠোট বেয়ে।। সে কী উচ্ছাস আর আবেগ !

স্ত্রী-দোয়েল কিন্তু গান গাইতে পারে না। তবে প্রয়ােজনে ডাকতে পারে কর্কশ স্বরে। স্ত্রী যখন ডিমে তা দেয়, বাচ্চাদের খাওয়ায়, পুরুষ-দোয়েল পাহারা দেয়। শত্রু দেখলেই সর্তক-সংকেত দেয়। স্ত্রীও সতর্কসংকেত দিতে জানে। বাসার কাছে শত্রু এলে, যত দূরেই থাকুক না কেন, পুরুষ-দোয়েল | টের পেয়ে যায়। ধেয়ে আসে। বিড়াল-কুকুর-সাপ-গুইসাপ-বনবিড়াল-বেজি কিংবা শিকারি পাখি কাউকেই সে কেয়ার করে না। অথচ আক্রমণের জন্য তার ঠোট ও পা মােটেই উপযুক্ত অস্ত্র নয়।

প্রয়ােজন না হলে দোয়েল এক নাগাড়ে বেশি দূর ওড়ে না। মাটিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে খাদ্য খোজে। ধান কিংবা ভাত খাবার জন্য ওরা গেরস্থের গােলাঘর কিংবা রান্নাঘরেও ঢুকে পড়ে। উঠোন-বাড়ি জুড়ে ওদের অবাধ চলাচল। বন-বাগানের মাটিতে খাবার খোজার সময় অতি সহজে বেজিবনবিড়ালের খপ্পরে পড়ে চরম বােকামির পরিচয় দেয়। পােষা বিড়ালও খপ। করে ধরে ফেলে অনেক সময়।

খাবার খুঁজতে খুঁজতে সামনে নির্বিষ সাপ কিংবা বড় ধরনের ব্যাঙসহ গিরগিটি, গুইসাপের বাচ্চা পড়লে উত্তেজিত হয়ে মাটিতে ডানা ঝাপটায়। চেঁচায় তারস্বরে। লেজ টানটান হয়। সতর্কসংকেত দিতেও এদের জুড়ি মেলা ভার। সােনাব্যাঙের খপ্পরেও পড়ে এরা। সুযােগ পেলে সােনাব্যাঙ গিলে ফেলে দোয়েলকে। ওঁৎ পেতে থেকে সােনাব্যাঙ দোয়েলের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে শিকারি বাঘের মতাে।
 
দোয়েলের খাবার তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ, কেঁচো, সাপের ছােট বাচ্চা, শিমুল-মাদার ফুলের মধু, খেজুরের রস, পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিম, ফড়িং ইত্যাদি। সুযােগ পেলে মৌমাছি খায়। মৌচাকের মধু খায়। তালের রসও খায়। তেলাপােকা দেখলে ওদের আর হুঁশ থাকে না।

পুরুষ-দোয়েল লম্বায় ১৮-২২ সেমি.। উত্তেজিত হলে তার লেজ পিঠের ওপরে ৯০ ডিগ্রি কোণে খাড়া হয়ে থাকে। চোখের মণির রঙ পিঙ্গল। সাদাকালাের মিশ্রণে পুরুষ-দোয়েল এক অনন্য সুন্দর পাখি। পালকের প্রান্তে, পিঠের কাছটাতে যেন শরতের লম্বাটে সাদা মেঘ। লেজের কাছের পালকে সাদা দু’টি টান। ঠোট কালাে। খাঁজকাটা ডানা। গলা-মাথা-বুক ও কপাল। চকচকে কালাে। চোখের পাশটা ঘন কালাে। পায়ের উপরিভাগসহ পেট সাদা। বুজানাে অবস্থায় ডানা কালচে, তাতে সরু-সরু সাদাটে টান। পায়ের রঙ কালচে ধাতব। নখও কালাে। লেজের তলার রঙ বাদামি লালচে।

স্ত্রী-দোয়েল আকারে যেমন ছােট, তেমনি দেখতেও পুরুষের মতাে সুন্দর নয়। স্ত্রীদের শরীরে কালাে রঙ নেই বলতে গেলে। কালাের বদলে গাঢ় বাদামি আর ময়লা বালির মতাে রঙ, নতুবা তাকেও পুরুষ-পাখির মতাে লাগত। চোখের মণির রঙ জবা-লাল। সে চোখে সর্বক্ষণ যেন ভয় লেগে থাকে।

দোয়েল পরিচ্ছন্ন পাখি। নিয়মিত গােসল করে। গােলায় কিংবা শুকাতে দেওয়া ধানে যখন দোয়েল নাচে তখন মনে হয় বাংলাদেশ ধান-দোয়েলের দেশ। আবার শাপলা ও পদুবনের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যায় যখন, তখন মনে হয় পদ্মা কিংবা শাপলা-দোয়েলের দেশ।

দোয়েল উপকারি পাখি। কত রকমের ক্ষতিকর পােকামাকড় যে সে খায় ! সে ধানের বন্ধু। পাটের বন্ধু। শাক-সবজির বন্ধু। পরিবেশের বন্ধু!

দোয়েল হচ্ছে Muscidapidae বংশের, Turdinae উপবংশের পাখি। এই বংশে অনেক পাখি। বর্গ হচ্ছে Passeriformes. নিউজিল্যাণ্ড বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দোয়েল কিংবা তার জাতভাইরা আছে। আমাদের দেশে দোয়েলের জাতভাইরা হচ্ছে কালিশ্যামা বা কালােদোয়েল, শ্যামা, পাইড বুশচাট (কালাে ফিদ্দা), কস্তুরা ও গ্রাস। আমাদের নিজস্ব গ্রাস ছাড়াও শীতে পর্যটনে আশে কয়েক প্রজাতির গ্রাস। কালােদোয়েলের (ইণ্ডিয়ান রবিন) সঙ্গে আমাদের জাতীয় পাখির পুরুষের কিছুটা মিল আছে। তবে তা পুরুষটির সঙ্গেই। জাতীয় পাখি দোয়েলের ইংরেজি নাম হচ্ছে Magpie Robin. বৈজ্ঞানিক নাম Copsycus Saularis. জাত ভাইদের ভেতর একমাত্র ওই-ই পরের বাসা দখল করে। পাশাপাশি মৌমাছিরাও (খােড়লের মৌচাক) অনেক সময় দোয়েলকে ঘরছাড়া করে নিজেরাই মৌচাক গড়ে। এই ক্ষেত্রে দোয়েলের মুখখানা হয় দেখার মতাে।

দোয়েলের খাদ্যাভাব নেই। বাসা বাঁধার জায়গারও অভাব নেই। তবে, পেতে রাখা ‘তে-কাঠি’র আঁঠার ফাঁদের  তেলাপােকা, গুবরে পােকা কিংবা ফড়িং ধরতে গিয়ে ওরা বন্দি হয় অনেক সময়। অনেকে অকারণে গুলতি দিয়ে মারে। হাত পাকাবার জন্য এয়ারগান দিয়ে মারে। অকারণে ডিম-বাচ্চাও নষ্ট করে। কিন্তু এসব করা উচিত নয়। সবার উচিত, এসব ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা। কেননা, একটি পাখিকে অকারণে কষ্ট দেবার কোনাে অধিকারই মানুষের নেই।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url