বাংলাদেশের পাখি : শ্যামা
সুরেলা শিস ভেসে আসছে দেবদারু বনের ভেতর থেকে। সূর্য নেমে গেছে। গাছপালার আড়ালে, বনতল ছায়াছায়া, মায়া জড়ানাে পরিবেশ বনভূমি জুড়ে। অল্প অল্প হাওয়া বইছে, দু'একটি প্রজাপতি উড়ছে, দেবদারুর ঝরাপাতা ঘুরতে ঘুরতে নেমে থেমে থেমে যাচ্ছে। বিশাল বিশাল সব দেবদারু গাছ। তলায় আনারস বাগান। আনারস গাছের একটি পাতার ওপরে বসে পাখিটি গান গেয়ে চলেছে আপন মনে। কত যে সুরের ওঠানামা তার গলার ভেতরে ! | চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ওর মােলায়েম শিস। বনভূমি নিস্তব্ধ যেন ওই হৃদয় । মাতানাে গানে। কান পেতে ওই গান শুনছে যেন বনের গাছগাছালি। কী। মিষ্টি ওর গলা। ধাতব ও তীক্ষ্ণ সুর। যেনবা ও শিস দিচ্ছে সুরেলা কোনাে বাঁশির ভেতর দিয়ে। তিন-চার বার ডাকছে, তারপর লম্বা টানে শেষ করছে। আবারও শুরু করছে।
যে গান গাইছে, সে পুরুষ। আনারস পাতার ওপরে বুক মিশিয়ে বসে আছে সে। সুন্দর লম্বা লেজটি প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। লেজের মাপ পাকা ১৭ সেন্টিমিটার। লেজের পালকের বুনট বেশ শক্ত। তলার রঙ সাদাটে, তাতে। হাল্কা বাদামি রঙের টান দিয়ে কেউ যেন জায়গায় জায়গায় খাঁজ কেটে দিয়েছে। ওড়ার সময় ওই খাঁজ বােঝা যায় না, দূর থেকে লেজের তলা সাদা বলেই মনে হবে। লেজের গােড়ায়, পিঠের ঠিক নিচে চৌকো সাদা ছােপ। লেজের অগ্রভাগ সমান নয়, কিছুটা খাঁজকাটা ধরনের। লেজের পালকের উপরিভাগ কালাে, এমনই কালাে যে, তাতে তীর্যকভাবে রােদ পড়লে যেন আলাে প্রতিফলিত হয়। পাখিটি যেন নিয়মিত তার লেজের উপরিভাগে কাজল মাখে। মাথা ও পিঠের উপরিভাগও কালাে। গলার নিচ থেকে ঘাড় ও বুকের কিছুটা অবধি ওই কালােই। তবে তা মাথার কালাের চেয়ে বেশি গাঢ়। ঠোট হাল্কা কালাে। ঠোট লম্বায় মাত্র দু' থেকে তিন সেন্টিমিটার। বুকের কালাে যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু চমৎকার রঙের। যেন হাল্কা আলতা মেখে নিয়েছে সে। তার সঙ্গে বাদামি, কমলা ও পিঙ্গলের হালকা মিশেল। পায়ের যে অংশটুকুতে লােম রয়েছে, সেটুকুও ওই আলতা রঙের। লেজের তলার কিছুটাও ওই রঙের। ছায়া জায়গায় থাকলে ওই রঙকে কমলালেবুর শুকনাে খােসার রঙের মতন মনে হয়। পাখার পালকের অগ্রভাগ তীর্যক । পাখার উপরিভাগ কালাে। লেজের পালকের পাশে পাশে সাদার টান পাখিটিকে আরাে সৌন্দর্য দান করেছে। তার লিকলিকে পায়ের রঙ লালচে গােলাপি। চোখের মণির রঙ কিছুটা বাদামি। সে গােসল করে নিয়মিত, শরীরের পালক ও লেজের লম্বা পালক সে নিয়মিত সাফসুতরাে রাখে। গােসল করে সে বনবাগানের ছােট ছােট ডােবানালায়। বেশ সময় নিয়ে, ডানা ঝাপটিয়ে গােসল করে সে। তারপর কোনাে গাছের ডালে বসে বেশ সময় নিয়ে পালক প্রসাধন করে। গােসলের পর তাকে আরও সুন্দর লাগে। তার লেজটি মাপ মতাে কেটে যদি উপরের দিকে তুলে ধরা হয়, তাহলে প্রথম দর্শনেই তাকে দোয়েল বলে মনে হবে। তার দেহ-মাথা ও চাহনিসহ স্বভাব চরিত্রে বেশ কিছু অভিন্ন মিল রয়েছে। তবে দোয়েলের দেহ যেমন ফোলা ফোলা, এর তেমন নয়। স্ত্রী পাখির রঙ ধূসর পিঙ্গল।
যে গান গাইছে এখন আনারস পাতার ওপরে বসে, বিদায় জানাচ্ছে। আজকের দিনটিকে, সে পুরুষ। কণ্ঠে তার খুশি উপচে পড়ছে। কণ্ঠস্বর হচ্ছে ‘সুসিপ সিক সিক’। অন্য সুরেও ডাকে। সে ডাকছে, কেননা, একটু ওপাশেই ডিম বুকে নিয়ে বসে আছে স্ত্রী, আগামী সকালের আগে আর বাসা ছাড়ার ইচ্ছে নেই তার। ৪ দিন খোঁজাখুঁজির পর এই গভীর ও নিভৃত বাগানে তারা বাসা বাঁধার যুৎসই জায়গা পেয়ে গেছে। আনারস গাছের মাথার ভেতরে। বেশ একটা বাসা তারা বেঁধেছে ৬ দিনের পরিশ্রমে। বাসার উপকরণ হচ্ছে। গাছের শুকনাে শিকড়, গাছের শুকনাে পাতা, কিছু শুকনাে ডালপালা। চারটি ডিম হয়েছিল। একটি অসাবধানে নষ্ট হয়ে গেছে। কোনাে অসুবিধা না হলে আর ১০দিন পরে তুলতুলে বাচ্চা হবে। প্রথম দিন পেড়েছিল ১টি ডিম। তার পরদিন ২টি, পরদিন আরেকটি। নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ডিম থেকে বাচ্চা বেরুবে প্রথমে। ডিম ফোটে ১৩–১৫ দিনে। বাচ্চা হলে কী যে মজা হবে ! স্বামী তাে তার অলস ভীষণ। বাসা বাঁধতে সাহায্য করে নি একটুও। কেবলই গলা ছেড়ে গান আর গান। অবশ্য বাচ্চাদের খাওয়াবে সে পরম সােহাগে। পাহারা দেবে বাসা। অবশ্য মাঝে-মধ্যে বাসায় বসে। ডিমগুলাে ঠোট দিয়ে উল্টে-পাল্টে দেয়। আর খুশিতে কেবলই গান গায়। শত্রু এলে কর্কশ স্বরে চেঁচায়। ধাওয়া করে। ডিম অনেকটা দোয়েলের ডিমের মতাে। আমি বহুবার ডিম দেখেছি।
স্ত্রীকে মাঝে-মধ্যেই দেখে নিচ্ছে পুরুষটি, গান কিন্তু থামাচ্ছে না। স্ত্রীও কম সুন্দরী নয়। তারও রয়েছে বাহারি লেজ। তবে রঙ অত সুন্দর নয়। পিঠের রঙ কালাে নয়, হাল্কা ধূসর। তার সঙ্গে পােড়ামাটির ধুলাের যেন মাখামাখি।বুক পেটের রঙ পােড়া ইটের মতন। পুরুষের চেয়ে কম সুন্দর সে।
বনতলে আঁধার নামছে দ্রুত। পুরুষ হঠাৎই গান থামাল। আনারস পাতার ওপর থেকে বুক তুলে শরীরের পালক একটু ফোলাল, তারপর ঝট করে উড়ে ঢুকে পড়ল বেতঝাড়ের ভেতর। রাতটা সে সরু বেতের ওপরে বসেই কাটিয়ে দেবে। স্ত্রী বাসাতেই বসে থাকবে চুপচাপ। লেজ নেমে গেছে আনারস গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কাছে আসতে পারে শেয়াল-খাটাস-সাপ। কিন্তু ঝরাপাতার জন্য কেউ নিঃশব্দে আসতে পারবে না। খসখস আওয়াজ উঠলেই সে মরার মতন চুপচাপ থাকবে। বিপদ বুঝলে অন্ধকারেই পাখা মেলবে। যদি সে ঘুমিয়েও যায় অসুবিধা সেই। পুরুষ পাখি বেতঝাড়ে বসে চাপাস্বরে শিস বাজাবে, ওটা বিপদধ্বনি।
এই যে পাখিটির কথা এতক্ষণ বললাম তার নাম শ্যামা। দোয়েলের জাতভাই সে। শরীরের মাপ ২৮ সেমি.। অনেকেই হয়তাে নাম জানে তার, কিন্তু আমি স্থির নিশ্চিত অনেকেই চোখে দেখে নি তারে। ঢাকা চিড়িয়াখানায়ও সে নেই। যারা বইপত্রে তার সম্পর্কে পড়েছে, ছবি দেখেছে, তারাও কিন্তু বলতে পারবে না এই পাখিটির গানের কণ্ঠ কেমন। দোয়েল গান গায় ‘সিইসি–। কিন্তু এই পাখি কীভাবে,কী ভঙ্গিতে গান গায় তা কোনাে পাখি বিশেষজ্ঞদের (এই উপমহাদেশের) বইতেও আমি পাই নি। তাই শুধু এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে যে, সে সুন্দর গান গায়। কিন্তু কেমন সুন্দর, কতখানি মিষ্টি, তা জানতে হলে শুনতে হবে তার গান। কিন্তু তার গান। শােনা তাে দূরে থাক, তাকে দেখাও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রথমত, সে থাকতে ভালবাসে বড় বড় বনবাগানের গভীরে, গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়।। সে ভীষণ লাজুক পাখি, সতর্ক পাখি। তাই বলে ভীতু নয়। বাসার ধারে কাছে বেজি-গুইসাপ দেখলে সে দোয়েলের মতন ঘিরে ধরে। কিন্তু মানুষ দেখলে পালায়। আসলে মানুষকে সে এড়িয়েই চলতে চায়। তার কাছাকাছি গিয়ে যে তাকে একটু চোখ ভরে দেখবে, সে সুযােগ সে দেবে না কাউকে। অথচ মানুষ তাকে খায় না, মারে না, বরং ভালবাসে। সুযােগ পেলে খাঁচায় পুরে পােষে। মানুষের মতন রােদকেও সে বােধহয় শত্রু মনে করে। না পারতে রােদ সে শরীরে মাখে না। কী জানি, ওতে তার শরীরের রঙ নষ্ট হয় কিনা। তবে শিকারি পাখির তাড়া খেয়ে অনেক সময় সে বেরিয়ে আসে, এক্ষেত্রে অন্য পাখিরা কিন্তু করে উল্টোটা। সে এক এলাকায় একটা দিনও থাকতে চায় না। তার রয়েছে নিদারুণ ভ্রমণ বাতিক। সকালে এই গ্রামে তাে বিকালে অন্য গ্রামে। এভাবে সে গ্রাম থেকে গ্রাম পেরিয়ে যায়। শুধুমাত্র বাসা বাঁধার সময় তাকে থাকতেই হয় এক জায়গায়। তাও বাচ্চারা উড়তে শিখলেই পুরুষটি ভ্রমণে বেরয়। স্ত্রী যায় বাচ্চারা স্বাবলম্বী হবার পর। তারাও বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে। শ্যামাদের বাসা বাধার প্রিয় জায়গার ভেতরে সুপারির পাতা ও কাধির ওপরটা অন্যতম।
এদের ভ্রমণের একটা নির্দিষ্ট ছক আছে। সিলেট থেকে একটি পাখি হয়তাে পাড়ি দিল সুন্দরবনের দিকে। সে ঠিক সােজা পথ ধরেই এগুবে। সিলেট থেকে সুন্দরবন অবধি যদি একটা সরলরেখা টানা যায়, ওই সরলরেখা ধরেই এগুবে সে। ফিরবেও ওই রেখা ধরে। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি পাখি যদি উত্তর বঙ্গে যায়, সেও একই নিয়ম মানবে। কোনাে মাসে কোনাে বাগানে যেদিন তাকে দেখা যাবে পরের বছর ঠিক ওই মাসের ওই দিনটিতে কিংবা দু'চারদিন আগপিছে আবার তাকে ওই বাগানে দেখা যাবে। তার আসা-যাওয়ার মানচিত্র যদি এঁকে ফেলতে পারে কেউ, তাহলে সহজেই পেয়ে যাবে তাকে। তবে সে বড় কঠিন কাজ। যেমন কঠিন তার দেখা পাওয়া, তার চেয়েও বেশি কঠিন তার স্ত্রীকে দেখতে পাওয়া। এটা আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। বাসা হবার পরে অবশ্য মানুষ তার কাছাকাছি যেতে পারে।
সে যখন মনের আনন্দে গায়, তখন তা হয় মিষ্টি সুরেলা “পুউ উ উ –পিউউউস।” মানুষের শিসের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেওয়া চলে। ছড়ার ছন্দের সঙ্গেও মেলানাে যায়। একটানা সে ডাকতে পারে ২০ সেকেণ্ড, তারপর একটু দম নিয়ে আবারও ১৫ সেকেণ্ড – এভাবে সময় কমে আসে। ধানের নাড়ার বাঁশিতে আস্তে ফু দিলে যেমন সুরেলা সুর ওঠে, তেমনি ডাকে সে নিস্তব্ধ দুপুরে এবং সূর্য ডুবে যাবার আগে। অন্যান্য পাখির মতন ভােরে সে ডাকেই না বলতে গেলে। সে গান গাওয়ার সময় গাছের ডালে বুক মিশিয়ে বসে। তার কণ্ঠে আছে জাদু, অপরূপ কারুকাজ। তার গলার ভেতরে যেন বাংলাদেশের সব গায়ক পাখির সুরের মিশ্রণ রয়েছে। সে অবিকল দোয়েলের মতনও শিস বাজাতে পারে। তবে তার নিজস্ব গানের ভাষা, গায়কী ঢঙ ইত্যাদি একান্তই তার। বাংলাদেশে সে কোনাে দিন অধিক সংখ্যায় ছিল না, আজও তা নেই। সমভূমির চেয়ে পাহাড়-টিলা অঞ্চলের বনবাগান তার প্রিয়। সুন্দরবনে সে আছে বলে শুনেছি, নিজে কখনাে দেখি নি। বাংলাদেশের সব গ্রামেই দু-চার জোড়া শ্যামা দেখা যায়। পােষা শ্যামাও দেখা যেতে পারে। খাচায় বসেও সে গান গায়। ওই গান শুনে অনেক সময় বুনােশ্যামা চলে আসে। শ্যামা তার কণ্ঠে বিভিন্ন সুরে খেলতে পারে।
এদের বাচ্চারা মােটেও দুষ্টুমি করে না, ঝগড়াঝাটিও করে না। ১৭ দিন বয়সে উড়তে শেখে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যায় আরও ৭ দিন পরে। তখন নিজেরাই খেতে শেখে। এরা মূলত কীটপতঙ্গভােজী। নিয়মিত জল পান করে ও গােসল করে। লেজ খসে গেলে আবারও গজায়। বাঁশবনে আমি একবার লেজের দুখানি পালকই পাই। বহুদিন আমি তা সযত্নে রেখেছিলাম।
এই পাখিটির নাম শ্যামা। ইংরেজি নামও শ্যামা (Shama)। বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus Malabaricus, সৌন্দর্য বিচারে এবং গায়ক হিসাবে। সে দোয়েলেরও সেরা। সংখ্যায় দোয়েলের মতন থাকলে এবং খােলামেলা। হলে সেই-ই হয়তাে হয়ে যেত আমাদের জাতীয় পাখি।