বাংলাদেশের পাখি : মেছাে ঈগল

বাংলাদেশের পাখি : মেছাে ঈগল
বাংলাদেশের এই শিকারি পাখিটির নাম মেছােঈগল। মাছই প্রধান খাদ্য। ইংরেজি নাম Grey headed Fish Eagle, বৈজ্ঞানিক নাম Lchthyophag charyaets. এদেরকে মেছােবাজ, মাছিমুরালও বলে। 

বালিহাঁসের বাসার খবরটা ওর জানাই ছিল। বিলের কিনারার যে মস্তবড় তেঁতুল গাছটার মাথায় পাখিটি আর ওর বউ মিলে ডিম-বাচ্চা তুলছে আজ সাত বছর ধরে, সেই গাছটির ডালে বসেই সে নঙর রাখে চারদিকে। পূর্বদিকে বিল আর ধানের মাঠ, উত্তর দিকে ছােট একটা ধানের মাঠ ছাড়া আর সবই বন-বাগানে ছাওয়া। জনবসতি কম। প্রতিটি বাড়িতেই আছে হাস-মুরগি, পুকুরে মাছ, বন-বাগানে নানান রকম পাখি, মাছ, ব্যাঙসহ পাখির ডিম-বাচ্চা। এছাড়াও নির্বিষ গেছোসাপ (লাউবােড়া) খেয়ে দিব্যি আরামে আছে ওরা এই তল্লাটে। বর্ষাকালে মাছ তেমন শিকার করতে পারে , কিন্তু ব্যাঙ মেলে প্রচুর। গেরস্থ বাড়ির হাঁস-মুরগির ছানা তাে আছেই। ওই হাঁস-মুরগির ছানা খাওয়ার অপরাধে ওদের ওপর গত সাত বছরে বারকয়েক মৃত্যুদণ্ড জারি হয়েছে। কিন্তু কার্যকর করা যায় নি। বন্দুক হাতে মানুষ দেখলেই বিপদ বুঝে ফেলে ওরা, অস্ত্রটি তোলার আগেই উড়ে পালায়। 

তেঁতুলগাছটির এমন মগডালে ওদের মাচানের মতাে বড়সড় বাসাটি যে নাগালে পৌছানাে কোনাে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া বয়সী গাছটার কাণ্ড ও ডালে বড় বড় গর্ত ও খোদল, তাতে বিষধর সাপ থাকে বলেই এলাকাবাসীর বিশ্বাস। গাছতলায় দাড়িয়ে ঘন ডাল-পাতার কারণে বাসাটি দেখাও যায় না। তাই ওদের যেমন গুলি করা যায় নি, তেমনি নামানাে যায় নি ডিম-বাচ্চা। তবে গ্রামের তুখােড় ‘গাছারু সরতে আলি যখন তেঁতুল গাছটা থেকে হাত বিশেক দূরের একটা নারকেল গাছে চড়ে নারকেল পাড়ত, তখন সে ওপর থেকে বাসা ও ডিম-বাচ্চা দেখতে পেত, বারকয়েক সে ডাব ছিড়ে-ছুড়েও মেরেছে, কেননা বারই ডাব বাসায় ফেলতে পারে নি।

ওই নারকেল গাছটাও লম্বা বটে! অত উঁচু নারকেল গাছ এই তল্লাটে নেই। ওই গাছে চড়ে সরফে আলি গত সাত বছরে সাতবার ওই শিকারি পাখিটির ডিম দেখেছে, ডিমে তা দিতে, বাচ্চা ফুটতে, বাচ্চাদের খাওয়াতে ও বাচ্চাদের উড়ে যেতে দেখেছে। অন্যরা শুনেছে শুধু বাচ্চাদের খিদের কান্না। ওই নারকেল গাছটি যাদের, সেই বাড়ির এক কৌতূহলী কিশাের ডিম-বাচ্চার খবর নেবার জন্য সরতে আলিকে নারকেল গাছের মাথায় চড়িয়েছে বহুবার। সরফে আলি নারকেল গাছের মাথায় চড়ে খেলার ধারাভাষ্য বর্ণনার কায়দায় জোরে জোরে বর্ণনা করেছে ডিম-বাচ্চার খবর। কৌতুহলী কিশাের তা শুনেছে চরম আগ্রহে। অকারণে গাছারুকে গাছে চড়ানাের জন্য সে বাবার বকুনি যেমন খেয়েছে বহুবার, তেমনি অনেকেই তাকে পাগল বলেছে। কিশােরটি দমে নি। তার আগ্রহ কমে নি। পারলে সে নিজেই চড়ে বসত ওই নারকেল গাছে বা তেঁতুলগাছের মাথায়।

এ বছরও পাখি-দম্পতি নতুন কিছু উপকরণ এনে (প্রতিবারই ডিম পাড়ার আগে এরা বাসাটায় নতুন উপকরণ আনে, বছর যত যায় বাসা তত পুরু হয়, বড় হয়) বাসাটিকে সাজিয়েছিল। তারপর ডিম পেড়েছিল মেয়েপাখি। গত সাত বছরে যথাক্রমে ২, ৪, ২, ২, ২, ৩, ও ২ ডিম হয়েছিল। সরফে আলির হিসেব মতাে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছিল যথাক্রমে ৩৩, ৩০, ৩৫, ২৯, ২৯, ও ২৯ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শিখেছিল প্রতিবারই ৬০ থেকে ৬৩ দিনের ভেতর। দুটি পাখিকে ডালপালা নিয়ে উড়তে দেখলেই উৎসাহী সেই কিশোর বুঝে ফেলত, ডিম হবার সময় হয়েছে। সরফত আলির কষ্ট যেত তখন বেড়ে। দু'চার আনা বখশিস দিয়ে গােপনে গাছে চড়ানাে হত। তাকে। পাখির ডিম-বাচ্চার প্রতি তার কোনাে আগ্রহই ছিল না। লােভ ছিল দু'চার আনা পয়সার প্রতি। ডিম না হওয়া পর্যন্ত প্রায় রােজই তাকে একবার চড়তে হত গাছে (অনিবার্য কারণেই তার কোনাে আপত্তি থাকত না), ডিম হবার ২০/২৫ দিন পর থেকে আবারাে তাকে তাই করতে হত- বাচ্চা না। ফোটা পর্যন্ত। প্রথম বছর বাসা হয়েছিল মাঘ মাসে, তারপরে যথাক্রমে বােশেখ, অগ্রহায়ণ, ফান, ভদ্র ও পৌষ মাসে। গত পেীষের বাচ্চারা উড়ে

যাবার পরে মা-বাবার এখন ফুরসত। উড়তে শেখার পরেও বাচ্চারা মাবাবার সাথে ছিল এবার প্রায় ৩২ দিন। বাচ্চারা মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে কোথায় যেন চলে যায়। মাঝে মাঝে ফেরে, দু'চারদিন থাকে, আবারাে উধাও। এই সময় মাছ-ব্যাঙের অভাব থাকায় হাঁস-মুরগির বাচ্চার দিকে হাত বাড়ায়, বন্দুকধারীদের তাড়া খেয়ে আবারাে উধাও হয়। বাসা বাঁধার সময় ছাড়া দুটি পাখিকে এক জায়গায় বেশি একটা দেখাও যায় না। বর্ষা নামলেই দুটিতে আসে, স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে এলাকায় কখনাে বসে তেঁতুলের ডালে, কখনাে বা মস্ত লম্বা ওই নারকেল গাছটির পাতার ওপর। লক্ষ্য একটাই, শিকার ও খাবার। এবারাে বর্ষার শুরুতে এসে উদয় হয়েছে দুটিতে।

এখন শরৎকাল। মেয়ে-পাখিটি আশেপাশে নেই। পুরুষ বসে আছে তেঁতুলের ডালে। তেঁতুলের ডালে বসেই সে এ বছর বালিহাঁস দম্পতিকে বাসা করতে দেখেছে ১০০ গজ দূরের একটা মরা খেজুরগাছের গর্তে-যে গাছটি বিলের একেবারে কিনারে। ওই বাসায় যে বাচ্চা ফোটার সময় হয়ে গেছে, তা এই পাখিটির জানা। বালিহাঁসের বাসায় সে ঢুকতে চেয়েছিল বারকয়েক, গভীরতা বেশি হওয়ায় সাহস পায় নি। ঢুকতে পারলে মজা করে ডিম খাওয়া যেত। বালিহাঁসের তুলতুলে ছানা খেতেও খুব মজা। তাই এই মুহূর্তে অপেক্ষায় আছে—কখন বাচ্চা লাফ দেবে বাসা থেকে, পড়বে নিচের জলে। বালিহাঁসের বাচ্চারা ডিম থেকে বেরুনাের পরে বাসা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে আর শিকারি ওই পাখিটি তা ভালােই জানে। তাই এখন তাকিয়ে আছে খেজুর গাছটার দিকে। কোনাে এক সুযােগে (হয়তাে-বা আজই খুব ভােরে) আজ দুটি বাচ্চা লাফিয়ে নেমেছে জলে। তারপরে খােলা জায়গা পেরিয়ে চলে গেছে ধানক্ষেতে। বালিহাঁস বিলের মাথায় চক্কর দিয়েছে, দেখেছে ছানা দুটিকে, কিন্তু ডাইভ মারার সুযোগ পায় নি। ধান ক্ষেতের জলে ডাইভ মেরে লাভ হয় না। এখন তাই তক্কে তক্কে আছে—কখন আরেকটি ছানা বাসা থেকে লাফ দেয়। বালিহাঁসেরা কমপক্ষে ৯টি ছানা ফোটায়। দু'টি কেবল জলে পড়েছে, সাতটি বাকি।

বড়সড় একটি কালাে গুইসাপকে হেলেদুলে, বেশ রাজকীয় চালে আসতে দেখে মেজাজ খিচড়ে গেল শিকারি পাখিটির। ও ব্যাটা যদি বালিহাঁসের বাসা-বাচ্চার খবর জেনে যায়, তাহলে উঠে পড়বে খেজুর গাছটাতে। বাসার ভেতরে গলা-মাথা ঢুকিয়ে গাপুস করে গিলবে ডিমবাচ্চাগুলাে। পাখিটি তাই টান টান গলায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে গুইসাপটির দিকে। | গুইসাপটি যখন খেজুর গাছটার গােড়ায় চলে এল, তখন বালিহাঁস দম্পতি উড়ে এল ধানক্ষেতের দিক থেকে, বাসার ওপরে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল । আর হুঁশিয়ারি জানাতে লাগল। ওই ডাকাডাকি আর ঘােরাঘুরিতে গুইসাপটি বুঝে ফেলল বালিহাঁসের ডিম-বাচ্চা আছে কাছাকাছি। দাঁড়াল।

সে। তখনি মা-বাবার সাবধানী ডাককে বাসা থেকে লাফিয়ে পড়ার সঙ্কেত ভেবে একটি ছানা হাঁচড়ে-পাচড়ে বাসার মুখে উঠে এল। ১৫/২০ সেকেণ্ড সে দেখল নিচটা জল তাকে ডাকছে যেন হাতছানি দিয়ে। লাফ যখন দেবে সে তখন ভেতর থেকে আরেকটি বাচ্চা একইভাবে বাসার মুখে উঠে এল। ওর ধাক্কাতেই প্রথম বাচ্চাটি পড়ল নিচে। যেহেতু নিজের ইচ্ছায় লাফ সে দেয় নি, সেহেতু পড়ল সে জলের কিনারের নরম মাটিতে, সামলে ওঠার আগেই গুইসাপটি দৌড়ে গিয়ে মুখে ধরল ওকে। পর মুহূর্তেই দ্বিতীয় বাচ্চাটি লাফ দিল, পড়ল সে জলে, জলে পড়ে সে কী পুলক তার! আহা! জলের ছোঁয়া! জলই তাে তার ঠিকানা। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে লাফিয়ে পড়া গুইসাপটির মুখে চালান হল। গালে চাপা পড়া দু'টি তুলতুলে ছানা তড়পাচ্ছে খুব। গুইসাপটি খুব খুশি! ওই দুটিকে মুখে ধরেই সে প্রতীক্ষা করছে তৃতীয় বাচ্চাটির—হয়তাে বা লাফ দেবে এক্ষুণি। বালিহাঁসেরা ছটফট করছে আর উড়ছে ঘুরে ঘুরে। সে কী অস্থিরতা! ডাইভ মারার কায়দায় নেমে আসছে গুইসাপটির মাথার ওপর।

| তেঁতুলের ডালে-বসা শিকারি পাখিটি হতাশ কণ্ঠে ডেকে উঠল। মেজাজ চড়ে গেল ওর সপ্তমে। এমন লােভনীয় শিকার হাতছাড়া হবে হতচ্ছাড়া ওই গুইসাপটির জন্য। ডানা মেলল সে। ওকে ডানা মেলতে দেখে পিলে চমকে গেল বালিহাঁসের। উড়ে পালাল দূরে। ও এসে বসল খেজুর গাছটির মাথায়, গলা লম্বা করে নিচের দিকে তাকিয়ে গুইসাপটিকে ধমক ধামক মারতে লাগল। গুইসাপটি তখন মুখে-ধরা শিকার পেটে চালান করে দিল। বাসার মাথায় মা-বাবা বসেছে ভেবে তৃতীয় বাচ্চাটি উঠে এল বাসার মুখের মিহিস্বরে ডাকল, সঙ্গে সঙ্গে শিকারি পাখিটি ওর ডান পাখানা বাড়িয়ে বড়শির মতাে নখরগুলাে দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল তুলতুলে ছানাটিকে। নাগালে পেল না, ছানাটিও দিল লাফ, তখন বিদুৎবেগে উড়াল দিয়ে ডান পা বাড়িয়ে দিয়ে শূন্য থেকেই অলৌকিক কায়দায় নখরে গাঁথল ছানাটিকে। নিষ্ঠুর শিকারি ওকে নিয়ে বসল আবার খেজুর গাছের মাথায়। ঠুকরে ঠুকরে রক্তাক্ত করে ধারাল বক্র ঠোটে ছিড়ে ছিড়ে খেতে শুরু করল কচি মাংস।

খেতে সময় নিল মাত্র মিনিট তিনেক। তারপর চুপচাপ বসে থেকে গলাটি লম্বা করে অপেক্ষা করতে লাগল চতুর্থ ছানাটির। না, শিকার আর উঠল না বাসার মুখে।
পরবর্তী তিনদিনে বাকি ছানাগুলােকে একাই গাপুস করল ওই শিকারি পাখিটি । জলে লাফিয়ে পড়ার মুহূর্তে প্রতিবারই সে সার্কাসম্যানের মতাে অলৌকিক কৌশলে শূন্য থেকেই ধরল শিকার। একটিমাত্র ছানা ফসকে গিয়ে জলে পড়েছিল, দুবও দিয়েছিল, তবুও বাঁচতে পারে নি। ওকে নখরে গেঁথে যখন সে ফিরছিল লম্বা নারকেল গাছটির দিকে তখন কী অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় পাক খেয়ে নিচের দিকে নেমে ও যে আবারাে শূন্য থেকে শিকার গেঁথেছিল নখরে! সে এক মজার দৃশ্য, মুগ্ধ হবার মতাে দৃশ্য। এমনিতেই সে উড়তে পারে দ্রুতবেগে, ডাইভ মারতে পারে চমৎকার ভঙ্গিতে, শূন্যে পাক খেতে পারে, পলাতক শিকারকে ধাওয়া করতে পারে ঝড়ের গতিতে। বিষধর সাপ শিকারের সময় সে অন্যান্য শিকারি পাখির মতাে সাপের ঘাড় চেপে ধরে এক পায়ে, অন্য পা দিয়ে ধরে সাপের কোমর বা কোমরের নিচে- যাতে ছােবল মারতে না পারে, না পারে শরীর দিয়ে পা পেঁচিয়ে ধরতে। সাপের শরীরের পঁচি খুবই মজবুত।

অবশ্য শিকারি এই পাখিটির পায়ে লােম আছে অনেক, সাপের ছােবল ওই লােমশ পা ভেদ করে চামড়ায় নাগাল পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। মাটিতে দাঁড়িয়ে সে সাপের ছােবলকে ডানার কৌশলী আঘাতে অকেজো করে দিতে যেমন ওস্তাদ, তেমনি ওস্তাদ লম্বা পা বাড়িয়ে ঢালের মতাে সাপের ছােবলকে ফিরিয়ে দিতে। এদের প্রিয় খাদ্যতালিকায় সাপও আছে। এদের পা ও নখর যেমন মজবুত, ধারাল ও শক্তিশালী, তেমনি মজবুত ও শক্তিশালী ঠোট। ওপরের ঠোঁটটি বড়, ওই বড়টুকুই বড়শির মতাে বাঁকানাে। ওর ঠোটের ঠোকরে বনবিড়াল, গেছাে থাটাস, শিয়াল বা বিড়ালের বাচ্চার চোখ অন্ধ করে দিতে পারে মুহূর্তেই। বুদ্ধি খাটিয়ে এরা পলাতক শিকারকে ঝােপঝাড় বা গর্ত থেকে বের করে আনতে যেমন পারে, তেমনি একজোড়া পাখিতে মিলে পরিকল্পিতভাবে শিকারও করতে জানে। একটিতে শিকারকে ধাওয়া করে, অন্যটি শিকারের সম্ভাব্য পালানাের পথের দিকে গােপনে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। বাংলাদেশের অন্য একটি তুখােড় শিকারি পাখি পলাশ (Pallas's Fish Eagle) ঈগলের মতাে এই শিকারি পাখিদেরও প্রিয় খাদ্যতালিকায় আছে মৌমাছি, মৌমাছির ডিম-বাচ্চা ও মধু। বাংলাদেশে খুঁজলে কমপক্ষে প্রতি জেলায় এমন একজন মানুষের খবর পাওয়া যাবে-- যে মরেছে এই শিকারি পাখিটির ছােবল বা ডানার আঘাতে ক্ষেপে যাওয়া মৌমাছিদের কামড়ে। মৌচাকের দিকে উড়ে যায় এরা জঙ্গিবিমানের মতাে, ঝুলন্ত চাকের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবার সময় হয় পা বা ডানা চালায়-ভেঙে মাটিতে পড়ে চাকের একটা অংশ।

ক্ষেপে যাওয়া মৌমাছিরা ধাওয়া করলে ঝটপট ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে দূরে সরে যায়। মৌমাছিরা শান্ত হবার পর ফিরে আসে চোরের মতাে, মাটিতে নেমে মৌমাছির ডিম-বাচ্চা ও মধু খায়। মৌচাকে হামলা করার মুহুর্তে কাছাকাছি দিয়ে যদি যেতে থাকে কোনাে মানুষ বা পশু, তাহলে মৌমাছিরা তাকেই শত্রু ভেবে ঝাপিয়ে পড়ে। আক্রান্ত মানুষ বা প্রাণী আচমকা এ রকম আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আমি নিজে যেমন একবার এ রকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম ১৯৭৮ সালে, (পুকুর থাকায় ডুব দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম) তেমনি সুন্দরবনে একই কারণে বানরকে আমি মৌমাছির কবলে পড়তে দেখেছি। আমাদের গ্রামের এক বৃদ্ধও একই কারণে মারা গিয়েছিল-মৌচাকের টুকরা সরাসরি পড়েছিল তার মাথার ওপর। ওরা মৌচাকে কী কৌশলে হামলা করে তা দেখলে যেমন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় , তেমনি ওদের ডাইভ, আকাশে ডিগবাজি খাওয়া ও শূন্য থেকে শিকারকে ছোঁ মেরে ধরার কৌশলও চেয়ে দেখার মতাে।

শিকার নিয়ে উড়ে আসার সময় যখন ওরা একজোড়া দাড়কাক, ভুবনচিল বা শিকারি বাজের দ্বারা ঘেরাও হয় তখনাে দেখার মতাে দৃশ্য তৈরি হয় বৈকি। উল্লেখিত পাখিরা দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে শিকার হাইজ্যাক করতে চায়, পায়ে শিকার থাকায় শিকারি এই পাখিটি আকাশে লড়াই করার কৌশল খাটাতে পারে না, চায় পালাতে। তখন শুরু হয় যেন জঙ্গিবিমানের ‘ডগফাইট"। এই শূন্যে উঠে যায় সঁ করে, এই পাক খেয়ে নিচে নামে, নখর থেকে শিকার যদি যায়। খসে-পড়তে থাকে নিচের দিকে, তাহলে পাক খেয়ে, ডাইভ মেরে নেমে আবারাে নখরে গাঁথে পড়ন্ত শিকার। এ রকম ক্ষেত্রে যখন হাল ছেড়ে দিতে হয় তখন রাগে ধেয়ে যায় লুটেরাদের দিকে। ঘুরপাক খেয়ে ওপর-নিচ থেকে পা বাড়িয়ে আক্রমণ করতে চায়। একই জাতের দু'টি পাখির ভেতরে যখন এ রকম ঘটনা ঘটে, তখন শূন্যের ডগফাইট হয় বড়ই উপভােগ্য।

বাগেরহাট এলাকার লােকেরা বলে বাজকুড়ােল। শরীরের মাপ ৭০-৭৯ সেন্টিমিটার। এদের চেয়ে বড় পলাশ ঈগলকেও বাগেরহাট এলাকায়। বাজকুড়াল বলা হয়। বাংলাদেশে ছােট বাজকুড়ােলও ছিল এক সময়। বাগেরহাট জেলায় ভঠে নামক গ্রামে আমি ওদের বাসা দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালে। ওই একবারই ছােট্ট বাজকুড়ােলের (ছােট মাছমুরাল) বাসা দেখেছি। হাঁসের ছানা খাবার জন্য ওই গ্রামেরই আমার এক শিকারি বন্ধু দুটিকেই গুলি করে মেরে ফেলেছিল। ওর একটির মাপ হয়েছিল (তখন হাত দিয়ে মেপেছিলাম) আমার হাতের এক হাত আট আঙুল, অন্যটি এক হাত দশ আঙুল। সম্ভবত আমার হাতের মাপ তখন ছিল ১৭ ইঞ্চি। বুনােলতা দিয়ে মাপ নিয়ে সেই লতা মেপেছিলাম হাতে। | পেছন দিক থেকে দেখলে বড় মাছমুরালকে দেখায় ঘন বাদামি, তাতে হাল্কা লালচে আভা থাকে। ঘাড়-মাথা-গলা ছাই-ধূসর। সামনের দিক থেকে দেখলে মােটা লােমশ পা, পেট, লেজের আগার ইঞ্চিখানেক বাদে বাকিটা সাদা। ওই ইঞ্চিখানেকের রঙ কালাে। গলা-বুকের রঙ বাদামি। ঠোটের বাঁকানাে অংশ কালাে। সাদা লম্বা ঢাউস ধরনের এই বুদ্ধিমান শিকারি পাখিটিকে দেখতে ভালােই লাগে। ছােট মাছমুরালের গড়ন-ধরনও একই রকম। ওদের পেট বেশি সাদা। শরীরের ধূসর-বাদামি রঙ বেশি গাঢ়। লেজের সাদা রঙটিও বেশি চকচকে। দূর থেকে দেখলে বড় মাছমুরালের বাচ্চা বলে মনে হতে পারে।

| মাছমুরালের প্রধান খাদ্য মাছ। বিল-ঝিল, হাওর-বাওড়, নদীতীর বা মােহনায় এরা গাছে বসে খেয়াল রাখে জলের দিকে। মাছ ভাসলে ডাইভ মেরে নখরে গাঁথে। এছাড়া ব্যাঙ, পাখির ডিম-বাচ্চা খায়। সাহসী পাখি এরা। একবার মুরগি জবাই করে উঠানে ছেড়ে দেবার পর মুরগিটি যখন তড়পাচ্ছিল, তখন আচমকা একটি মাছমুরাল ডাইভ মেরে সেটা তুলে নিয়েছিল। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য! আবার গুলি খাওয়া পাখি যখন পালাতে চায় তখনাে ধরতে দেখেছি আহত পাখিকে।

শীতকাল বাদে বছরের যে কোনাে সময়ে বাসা করতে পারে এরা। বাসার জায়গা পছন্দে লাগে ২-৫ দিন। তারপর দুজনে মিলে বাসা সাজায়। শুকনো ও কাচা ডালপাতা ঠোটে ভেঙে, ঠোট ও পা দিয়ে ধরে ওড়ে। বাসা শেষ হয় ৫-৭ দিনে। তারপর ডিম। ডিমের রঙ সাদা। দুজনে পালা করে তা দেয়। ৩৫ দিনের ভেতর ডিম হােটে। বছরের পর বছর ওরা একই বাসা ব্যবহার করে বলে উৎসাহী শিশু-কিশােরেরা ইচ্ছে করলে ওদের আচারআচরণ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশের আরেক শিকারি পাখি খােপা ঈগলের বাসা এরা দখল করে নেয় অনেক সময়। আমার গ্রামে বর্তমানেও (২০০৮) একটি আমগাছে প্রতিবছর ডিম-বাচ্চা তােলে একজোড়া পাখি । ওই গাছে আগে বাসা ছিল খােপা ঈগলের। বছর পাঁচেক আগে দখল করেছে বর্তমানের মাছমুরাল দুটি। আমগাছটার মগডালের এমন জায়গায় বাসা যে, সেখানে চড়া কঠিন। এখানে উল্লেখ্য যে, লেখার শুরুতে যে তেতুল গাছটার কথা বলেছি আমি, সেই গাছ থেকে মাছমুরালকে হটিয়ে দিয়েছিল একজোড়া শকুন। শকুনেরাও একই বাসায় ডিম-বাচ্চা তােলে বছরের পর বছর। উৎসাহী সেই কিশাের ছিলাম আমি। গাছারু সরফত আলি মারা গেছেন। ২০০৭ সালে। নারকেল গাছ থেকে পড়ে। তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৭০ বদুর।

মাহমুরাল বাংলাদেশে আজো আছে সন্তাষজনক হারে। বেশি নজরে পড়ে ভাদ্র থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত। ঢাকা শহরের আশেপাশেও এদেরকে দেখা যেতে পারে। প্রতিটি শিকারি পাখিই প্রকৃতি-পরিবেশের বন্ধু। ধান ও আলুখেকো ইদুর খায়। মরা-পচা মাছ খেয়ে জল পরিষ্কার রাখে । বছর দশেক আগে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশে মাছের যে মারাত্মক ক্ষতরােগ দেখা দিয়েছিল, মারা গিয়েছিল বহু প্রজাতির মাছ, বিল-পুকুরের জল হয়ে পড়েছিল দৃষিত, তখন শিকারি পাখিরা ওইসব ভাসমান মৃত মাছ খেয়ে জলজ পরিবেশকে দূষণমুক্ত করেছিল। মরেও ছিল অনেক শিকারি পাখি।

ভালাে থাক মাছমুরাল। ওদের তীক্ষ্ণ ও ভয়ঙ্কর কণ্ঠ বাজুক বাংলাদেশের আকাশে। ওদের বাচ্চাদের খিদের মিষ্টি কান্না ঝরুক বাংলাদেশের বাতাসে। ডানা মেলে ওরা স্বচ্ছন্দে ভেসে বেড়াক বাংলাদেশের অসীম নীলিমায়।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Unknown
    Unknown ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ এ ৯:২৮ PM

    এই পাখির বিসয়ে আরো যানতে চাই।

Add Comment
comment url