বাংলাদেশের দেশের পাখি

বাংলাদেশের দেশের পাখি
বাংলাদেশের দেশের পাখি 

সুন্দরবন। কটকা নদীর মােহনার ওপরে চক্কর দিচ্ছে এক জোড়া সাদাবুক সাগর ঈগল। দুটি বনমােরগ আর সাতটি বন মুরগি চরছে কেওড়াবনের ভেতরে। সঙ্গে ওদের এক ডজন তুলতুলে ছানা। ওদের আশপাশ থেকেই উড়ন্ত পােকা-মাকড় ধরে খাচ্ছে একটি দুধসাদা দুধরাজ পাখি। গরানের ডালে বসে ডাকছে একটি ভীমরাজ পাখি। দুলে দুলে উড়ে কটকা নদী পাড়ি দিচ্ছে একটি কেশরাজ পাখি।

একজোড়া কালাে মাথা মাছরাঙ্গা বসে আছে নদীর পাড়ের একটা নিচু গাছে। কটকা সী-বীচে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। দু'টি গাঙচিল হােভারিং করছে ওখানে।

কটকা নদীতে এখন পূর্ণ ভাটা। জেগে গেছে নদীর পাড়ের চর। ওই চরের কিনারা জুড়ে সারি সারি কেওড়া গাছ। একটা কেওড়া গাছের মাথায় বসে আছে ১৭টি শামুকভাঙা পাখি। তার এ পাশে নদীর চর ধরে হেঁটে চলেছে ৩টি মদনটাক পাখি । আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চরছে গােটা কয়েক ছােট গুলিন্দা পাখি ।

একটু দূরে—খালের মুখের কেয়া-ঝােপের পাশে বসে পালক প্ৰসাধন করছে ৩টি সুন্দরী হাঁস (মান্ড ফিন ফুট) পাখি। বহুদূরে জঙ্গলের মাথার ওপরে ঘুরপাক খাচ্ছে একঝাক আলতাপরী পাখি ।
গারােপাহাড়। একটি পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল বুনােহাতি।

ওদের চারপাশে ঘুরছে একটি গাে-বক। একটি হাতির পিঠের ওপরে ঘুরে পােকা খুঁজছে ৪টি ভাত শালিক। ৭টি শঙ্খ শালিক খাবার খুঁজছে পাহাড়ের মাথার বিশাল একটা গাছের ডাল-পালায়। ওপাশের পাহাড়ের মাথা থেকে ভেসে আসছে ময়না পাখির বুক হিম করা শিস। হাতিগুলোর একটু ওপাশে, মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মােট ৭টি মােহনচূড়া পাখি। ওর ভেতরে ৫টি-ই বাচ্চা। উড়তে শিখেছে কেবল। গারাে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া টলটলে জলের পাহাড়ি নদী সােমেশ্বরীর বুকে ভাসছে ৩টি বালিহাঁস।

বাংলাদেশের পাখি : ঘুঘু
বাংলাদেশের পাখি : ঘুঘু


সােমেশ্বরী পাড়ি দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দিকে উড়ে চলেছে একঝাক বড় সাদা বক। এই যে দুটি জায়গার কথা বললাম আমি, বললাম কিছু পাখির . কথা—আরাে অনেক পাখি আছে-ওই দুটি এলাকায়। উত্তরে গারাে পাহাড়, দক্ষিণে সুন্দরবন, এটুকুর ভেতরেই তাে আমার দেশ-সােনার বাংলাদেশ। এটুকুর ভেতরেই আছে কত বন-বনানী, নদী-খাল, হাওর-বিল আর জলাভূমি। আছে নানান রকম পাখি।

আমার দেশটা যেমন গানের দেশ, তেমনি ফুল-পাখি-প্রজাপতিরও দেশ। আমার এই দেশটা যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর আমার দেশের পাখিগুলােও। প্রায় সাতশ' রকম পাখি আছে আমার দেশে। তার ভেতর প্রায় অর্ধেক পাখি আমার দেশে আসে বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে। আবার চলে যায়। ওরা তাই আমার দেশের স্থায়ী পাখি নয়।

আমার দেশের স্থায়ী পাখিদের শহর-নগর-বন্দরসহ প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। গারাে পাহাড় ছাড়াও আমার দেশে আছে পাহাড়িবন শালবন ও টিলাময় বন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি বনে ঘুরলে, সিলেটের টিলাময় বনে ঘুরলে এমন কিছু পাখি দেখা যাবে যা সুন্দরবন তাে বটেই, দেশের অন্য কোথাও নেই। যেমন, ধনেশ পাখি। আবার সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁসকে পার্বত্য বনে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বনমােরগ আর ভীমরাও পাখি সুন্দরবনে যেমন আছে, তেমনি আছে সিলেট-চট্টগ্রামে।

আমার দেশটা তাে পাখিরই দেশ। কত সুন্দর সুন্দর নামের পাখি যে আছে। ফুলঝুরি, চশমা পাখি, ভরত, নীলকণ্ঠ, বসন্তবৌরি, ফুটফুটি, লেজনাচুনে, কমলাবউ, হলদে বউ, সহেলি, মুনিয়া, খঞ্জন, দোয়েল, শ্যামা, নীলপরি, হালতি, বড় হালতি, পাপিয়া, ডুবুরি, রঙিলা বক, মথুরা, হট্টিটিসহ আরাে কত নাম। বিদঘুটে নামের পাখিও আছে আমার দেশে। যেমন, কসাই, হাঁড়িচাচা, গােবরে শালিক, জলড়াকাত ইত্যাদি।

বাংলাদেশের পাখি : টিয়া
বাংলাদেশের পাখি : টিয়া


আমার দেশের গানের পাখিরা কী সুন্দর গান গায়। কী চমৎকার শিস যে বাজায়! এ দলের কয়েকটি পাখি হচ্ছে আমার দেশের জাতীয় পাখি দোয়েল, শ্যামা, ফটিকজল, ভ্যাদাটুনি বা বাংলাদেশের নাইটিঙ্গেল, ভরত, ময়না ও মৌটুসি। পাশাপাশি হাঁটিচাচার কষ্ঠ কর্কশ। ভুতুমের ডাক যেন চারপাশে ভয় ছড়ায়। আবার চেঁচামেচিতে ওস্তাদ পাখিও আছে আমার দেশে। যেমন নীলকণ্ঠ ও হট্টিটি।

কিছু পাখি আছে যারা রাতের বেলায় চরে। এরা হচ্ছে নিশাচর পাখি। এ দলে পড়ে ভুতুম পেঁচার দল, নিশিবক ও দিনেকানা। ভুতুম পেঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইদুর খেয়ে বড় উপকার করে। শুধু পেঁচারাই নয়, সব পাখিই কোনাে না কোনােভাবে মানুষ তথা অন্যান্য প্রাণীর উপকার করে—প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় রাখে অপরিসীম ভূমিকা।

আমার দেশের সবচেয়ে ছােট পাখি হচ্ছে ফুলঝুরি। টিকে থাকা সবচেয়ে বড় পাখি হচ্ছে মদনটাক। ওজনের দিক দিয়ে শকুনই চ্যাম্পিয়ন। মদনটাক আর শকুন কমে গেছে। তবে, ঢাকার আকাশেও মাঝে-মধ্যে শকুন দেখা যায়—সুন্দরবনে গেলে মদনটাক দেখা যেতে পারে।

পাখি দেখার, পাখির বাসা খোজার বা পাখির ডিম-বাচ্চা দেখার নেশা যাদের আছে, আছে পাখির গান বা ডাক শােনার নেশা, তারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে বিশেষ বিশেষ ঋতুতে আমার দেশের গ্রামীণ বন, সুন্দরবন, গারােপাহাড় এলাকা, সিলেটের টিলাময় বন ও বান্দরবান-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটির পাহাড়ি বনসহ বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়ে যেতে পারে। ঢাকা শহরে যারা থাকে, তারা রাজধানীবাসী পাখিদের দেখে সাধ মেটাতে পারে। মানুষের মতাে বহু রকম পাখি রাজধানী ঢাকরি স্থায়ী বাসিন্দা।

একটি পাখিকে দেখার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তার চেয়ে বেশি আনন্দ ও উত্তেজনা আছে একটি পাখির মৌলিক আচার-আচরণগুলো দেখার মধ্যে। একটি পাখি কী পদ্ধতিতে বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচন করছে, কী কৌশলে নির্মাণ করছে বাসা, ডিম দিচ্ছে কটাসে ডিম ফুটছে কতদিনে-কতদিন পরে বাচ্চারা উড়তে শিখছে, এ সব যদি স্বচক্ষে দেখা যায়, হিসাব-নিকাশ রাখা যায়, তাহলে একটা আবিষ্কারের আনন্দ অনুভব করা যায়। এই ঢাকা শহরে থেকেও দু'পাঁচটি পাখি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন কোনাে কাজ নয়।

বাংলাদেশের পাখি : চিল
বাংলাদেশের পাখি : চিল


দরকার শুধু কিছুটা সময় আর অসীম ধৈর্য । 'আমার দেশটা পাখির দেশ। সাজগােজ করে পাখি দেখতে না বেরুলেও ১০-২০ রকমের পাখি এমনিতেই নজরে পড়ে। এ রকম দেশে জন্মগ্রহণ করায় গর্বিত আমি। আমি ‘পাখির গানে ঘুম ভাঙ্গানাে সকাল চাই, পাখির ডানার সূর্য ডােবা সন্ধ্যা চাই'।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url