বাংলাদেশের : পােষা পাখি

আমাদের পােষা পাখি
আমাদের পােষা পাখি

শীতের বিকেল বেলা। ছােট ফুলবাগানের ফুলগাছগুলােতে জল দিচ্ছে নিপু। এমন সময় কাছের লিচু গাছটার মাথায় ঝড় উঠল যেন। তাকিয়েই চমকে। গেল ও। বিশাল একটি পাখি লিচুর সরু ডালে দু'পায়ের ভর রাখতে চেষ্টা করছে, পারছে না। বিশাল দুটি ডানা মেলে ধরে ঝাপটাচ্ছে প্রবল। কী বড় ওর ঠোট! ডান ডানাটার গােড়া ওর ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে নিপু চেঁচাতে শুরু করল। ছুটে এলেন ওর বাবামা। পাখিটিকে দেখে বাবা হেসে বললেন যে, এটার নাম হচ্ছে শামুকভাঙ্গা পাখি। কোনাে শিকারি একে গুলি করেছে, আহত হয়েও এতদূর উড়ে এসে দম ফেল করে পড়েছে ওই লিচু গাছের মাথায়। ভালােই হল। মাংস খাওয়া যাবে।
বাঁশের লগি দিয়ে পাখিটিকে পেড়ে ফেলা হল নিচে। নিপুর বাবা কৌশলে ওর দু'ডানা ধরলেন ।

ডানার ঝাপটায় পাখির রক্ত ছিটকে এসে লাগল তার জামা-কাপড়ে। পাখিটি তার লম্বা ঠোট দিয়ে ঠোক্কর মারতে চাইছে, পারছে না। নিপুর বাবা খুব খুশি। বললেন, এই পাখির ঝাঁক তাে প্রায়ই আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যায় সুন্দরবনের দিকে। ওদিক থেকেও আসে। ওরা নামে গিয়ে বিল কোদালিয়ায়।

রক্তাক্ত পাখিটিকে যখন বাড়ির উঠানে আনা হল, নিপুর মনটা তখন কেদে উঠল। মুক্তি পাবার জন্য পাখিটি ছটফট করছে। ভয়ে ওর চোখ দুটি গেছে ঘােলা হয়ে। নিপু তখন বলেই ফেলল তার মনের কথা। পাখিটিকে পুষবে সে। ভালােবাসবে। খাওয়া চলবে না ওকে। রাজি হলেন ওর বাবামা। নিপুর একটি খাঁচাবন্দি পােষা টিয়া আছে। নিপুকে দেখলেই ‘নিপু-নিপু বলে ডাক ছাড়ে। বুলি ফুটেছে ওর মুখে। ঘরের বারান্দার চালায় ঝুলানাে থাকে খাঁচাটি।।

নিপুর বয়স ১০ বছর। বাবা-মা'র খুবই আদরের। শামুকভাঙ্গা। পাখিটিকে তাই পােষার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ডেকে আনলেন পাড়ার এক ডাক্তারকে। তিনি ক্ষতস্থানে কী সব পাউডার লাগিয়ে দিলেন। ভালাে করে পরীক্ষা করে দেখলেন ক্ষতস্থানে কার্তুজের দুররা বিধে আছে কিনা। নেই ।

ঘরের তিনটি রুমের সবচেয়ে ছােটটিতে রাখা হল পাখিটিকে। তড়িঘড়ি পুকুর থেকে ছােট-বড় শামুক, মাছ ও ঝিনুক তােলা হল। একটি গামলার জলে রাখা হল মাছগুলােকে। শামুক-ঝিনুকগুলােকে রাখা হল মাটির মেঝেতে। একগাদা কুটো এনে এক কোনায় পাখিটির জন্য বাসা মতাে করে দেয়া হল। কিন্তু পাখিটি ওদিকে তাকাল না পর্যন্ত, চারপাশে হেঁটে হেঁটে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল, ঝাপটাতে লাগল ছানা।

পরদিন সকালে চুপি চুপি নিপু উকি দিল ঘরে। দেখে, পাখিটি গামলার জল থেকে মাছ খাচেছ । তারপর সে একটি মাঝারি শামুক তুলে নিয়ে এল ঠোটের মাঝ বরাবর, দু'ঠোটের ফাকের ওই জায়গাটা বেশ একটু “ফাকামতন। ওখানেই শামুকটা ধরে চাপ দিতেই কটাস শব্দে ভেঙ্গে গেল শামুকের শক্ত খেলা।

খােলা ফেলে পাখিটি শামুকের মাংস খেতে লাগল। তখন খুশিতে নিপু যেই না ঘরে ঢুকল, অমনি ডানা ঝাপটে সরে গেল পাখিটি। একটু সরে এসে নিপু দাঁড়িয়ে রইল দেখবে সে পাখিটির খাওয়া। কিন্তু পাখিটি টানটান গলায় তাকিয়েই রইল, খাবার খাচ্ছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে এল নিপু। চুপি চুপি বেড়ার ফাক দিয়ে তাকাতেই দেখে, খাচ্ছে পাখিটি। সে বুঝল, মানুষের সামনে ও খেতে ভয় পায়।

বিশ দিনের ভেতর পাখিটি পােষা হয়ে গেল। ওই বদ্ধ ঘরের জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেল। নিপুর সামনেও খাবার খায়। ভয়ও পায় না তেমন। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায় কুটোর বাসায়। বিকেলের দিকে ওর পায়ে দড়ি বেঁধে নিপু ওকে হাঁটাতে নিয়ে আসে ফুলবাগানের সামনে। পাখিটি হাঁটে। লাফ দেয় । পাখা মেলে উড়ালও দিতে চায় মাঝে-মধ্যে। আকাশ পথে কোনাে পাখি উড়ে গেলে ঘাড় কাত করে ও তাকিয়ে থাকে টানটান গলায়। ও এখন পুরােপুরি সুস্থ।

বাংলাদেশের পাখি : টিয়া
বাংলাদেশের পাখি : টিয়া


সেদিন বিকেলেও নিপু পাখিটিকে হাঁটাচ্ছিল খােলা মাঠটাতে। দূর থেকে ধীর লয়ে উড়ে আসছে বিশাল একঝাক শামুকভাঙ্গা। এ কদিনে বাবার কাছে সে শামুকভাঙ্গা সম্পকে অনেক তথ্য জেনেছে। বার কয়েক উড়েও যেতে দেখেছে ঝক। এই আঁকটি দেখে তার মনে হল, বন্দি পাখিটিকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়। পাখিটির পায়ের রশি খুলে দিল সে।

পরম সােহাগে পাখিটিকে ধরল বুকের কাছে। উড়ন্ত ঝকটি কাছাকাছি আসতেই শন্যে ছুঁড়ে দিল সে হাতের পাখিটিকে। সঙ্গে সঙ্গে দু'বার ডাক ছেড়ে নিপুকে বােধহয় ধন্যবাদ জানাল পাখিটি। তারপর বিশাল দু’ডানার বাতাসে নিপুর চুলগুলােকে এলােমেলাে করে দিয়ে উড়ে গেল পাখিটি—মিশল গিয়ে উড়ন্ত পাখির ঝাঁকে। চলল সুন্দরবনের দিকে।

নিপুর মন ভরে গেল অনাবিল শান্তিতে। চোখ উঠল ভিজে। একটি পাখিকে মুক্তি দেবার মধ্যে এতটা আনন্দ! এত শান্তি! সঙ্গে সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত নিল, ছেড়ে দেবে পােষা টিয়াটিকেও। চলে এল সে বাড়ির উঠানে। ছেলের কথা শুনে বাবা হেসে বললেন, শামুকভাঙ্গাটা প্রকৃতিতে টিকে থাকার মতাে সব ট্রেনিংই পেয়েছিল। চিনেছিল শত্রু-মিত্র। ও টিকে থাকবে।

খাবার খেতে পারবে। কিন্তু এই টিয়াটাকে আবেগের বশে ছেড়ে দিলে টিয়াটিকে হত্যা করার মতাে কাজই করা হবে। ওকে আনা হয়েছিল বাচ্চা অবস্থায়। বুনাে জীবনের কোনাে ট্রেনিংই ও পায় নি। চেনে না খাবার, জানে না শত্রু-মিত্র কারা। প্রকৃতিতে টিকে থাকার সব রকম যােগ্যতাই ও হারিয়েছে। ওকে ছেড়ে দিলেও ফিরে আসতে চাইবে ওর অভ্যস্ত জীবনে।

যদি চলেও যায়, বাঁচতে পারবে না ও। | নিপু বুঝল বিষয়টি। টিয়াটিকে ছাড়ল না। তবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, বাকি জীবনে সে আর কোনােদিন কোনাে পাখি পুষবে না। পাখির ঠিকানা হচ্ছে মুক্ত আকাশ। তাকে বন্দি করে রাখা বা বুনাে জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়। পাখির ডানার স্বাধীনতাকে কোনাে মানুষেরই হরণ করা উচিত নয়।

উপরে উল্লিখিত দু'টি পাখিই কিন্তু ছিল পােষা। ওরা পােষ মেনেছিল। কিন্তু এই পােষ মানারও রকমফের আছে। কী রকম?

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে জেনে নেয়া যাক পােষা পাখি কাকে বলে?

আমার মতে পােষা পাখি হচ্ছে সেই সব পাখি, যেসব বুনাে পাখিকে ধরে খাঁচায় বন্দি করে রাখলেও সুস্থ থাকে, সজীব থাকে, নিয়মিত খাবার খায় ও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ডাকাডাকি করে বা গান গায় এবং উপকরণ ও জায়গা থাকলে বাসা বাঁধে ও ডিম পেড়ে সেই ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়, সেই বাচ্চাদের খাওয়ায় ও আদর করে, সেই সব পাখিই হচ্ছে পোষা পাখি। খাঁচা ছােট হতে পারে, মাঝারি হতে পারে আবার অনেক বড়ও হতে পারে। বিশাল জায়গা জুড়ে উচু উচু গাছগুলােকে ভেতরে রেখেও চমৎকার বেষ্টনী করা যায়, ওর ভেতরে পাখিরা বলতে গেলে বুনােপাখির মতােই স্বাধীন থাকে। চিড়িয়াখানাতেই সাধারণত এই ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির ছাদ বারান্দায় বড় জায়গা করা যায়।

এবার দেখা যাক পােষ মানার রকমফেরটা কী রকম :

ক) মুক্ত পােষা পাখি : 

যেসব পাখি পােষ মানার পরে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিলেও উড়ে চলে যায় না, পােষক বা পােষকদের আশপাশেই থাকে, ডাক দিলে উড়ে এসে হাতে, ঘাড়ে বা মাথায় বসে, বিশ্রামের সময় হলে খাঁচায় ঢুকে পড়ে, তারাই হচ্ছে মুক্ত পােষা পাখি। এদেরকে ছেড়ে দিয়েও পােষা চলে দিব্যি। এ রকম পাখির উদাহরণ হচ্ছে—আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল (ম্যাগপাই রবিন), কমলাবউ (অরেঞ্জ হেডেড গ্রাউন্ড গ্লাস), ভীমরাজ (ব্যাকেট টেইল্ড ড্রোঙ্গো), ডাহুক (হােয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন), কালিম (পার্পল মুরহেন), কোড়া (কোরা), বুলবুল (রেড ভেন্টেড বুলবুল) ও দুংকর (ইন্ডিয়ান মুরহেন)। তবে পােষক ভালাে না হলেও পােষা।

পাখিটির বয়স (পােষাকালীন বয়স) একটু বেশি হলে এবং বাচ্চা অবস্থা থেকে পুষতে শুরু করলেই কেবল মুক্ত পােষা পাখি পাওয়া যেতে পারে । মুক্ত পােষা পাখি কালিম ডিম-বাচ্চাও দেয়, পােষা মুরগির মতাে বাচ্চাদের। নিয়ে চরাইও করে। কিশােরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার কিছু এলাকায়, শেরপুর জেলার একটি এলাকায় ও বাগেরহাট জেলার একটি গ্রামে আমি এ রকম মুক্ত পােষা কালিম ও তাদের কুশি কুশি ছানাদের দেখেছি। কিশোর বয়সে আমি দোয়েল, ডাহুক, হালতি, বনকোয়েল, বড় হালতি, কমলাবউ ও ডুংকর। পােষার চেষ্টা করেছিলাম।

খ) বন্দি পােষা পাখি : 

যেসব পাখি খাঁচাবন্দি করা ছাড়া পােযা চলে না, সুযােগ পেলেই উড়ে পালিয়ে যায়, তারাই হচ্ছে বন্দি পােষা পাখি । এ দলে সব পােষা পাখিকেই ফেলা চলে। |

গ) খাচায় অভ্যস্ত পােষা পাখি : 

যেসব পাখি খাঁচার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, চুপচাপ থাকে, খাঁচা থেকে পালাবার জন্য ছটফট করে না বা খাচা ভেঙে পালাবার কসরত করে না, তারাই হচ্ছে খাঁচায় অভ্যস্ত পােষা পাখি । এ দলে পড়ে তিলা ঘুঘু (স্পটেড ডাভ), ভাত-শালিক (কমন ময়না), সবুজ ঘুঘু (ব্রাঞ্জড উইংড ডাভ) ও শ্যামা ইত্যাদি। |

ঘ) খাঁচায় ছটফট পাখি : 

যেসব পাখি দিনের অধিকাংশ সময়ে খাঁচা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করে ফাঁক-ফোকর খোঁজে ও ঠোট-পা চালিয়ে খাঁচা ভেঙে পালানাের কসরত করে, তারাই পড়ে এই দলে। খাচায় অভ্যস্ত পােষা পাখিদের মনােভাব যেমন—খাচায় খুব সুখেই আছি, নিরাপদে আছি,' খাচায় ছটফট পাখিদের স্বভাব ঠিক এর উল্টো। হাবভাবে।

ওরা সব সময় প্রকাশ করে যে, ‘খাঁচার ভেতরে বড় যন্ত্রণায় আছি। মুক্তি পেতে চাই। এ দলে আছে টিয়া (আলেক্সজানি প্যারাকিট), লালবুক টিয়া (রেড ব্রেস্টেড প্যারাকিট), কষ্ঠি টিয়া (রােজ রিংগড প্যারাকিট), লটকন (লরি কিট), ময়না (হিল ময়না), সিপাহি বুলবুল (রেড হুইসকার্ড বুলবুল) ও অন্যান্য। টিয়ারা তাে সুযােগ পেলেই খাচার শিক কেটে পালায়। আবার, মুক্ত পােষা টিয়াও আমি ঢাকার রূপগঞ্জে দেখেছি। তবে এটা ব্যতিক্রম। |

বাংলাদেশের পাখি : মাছরাঙ্গা
বাংলাদেশের পাখি : মাছরাঙ্গা

এবার দেখা যাক বাংলাদেশের মানুষ কী কারণে পাখি পােষে:


ক) শুধুমাত্র শখের জন্য : 

বাংলাদেশের অনেক মানুষই পাখি পােষে শখের বশে। দেখতে ভালাে, মনকাড়া ডাক ছাড়ে বা গান গায়, অথবা নানান রকম সুন্দর সুন্দর কসরত দেখায় খাচার মধ্যে, এ কারণেই পাখি পােষে। এসব পােষকের প্রধান বিবেচ্য পাখির সৌন্দর্য। খাঁচায় বন্দি ঘুঘু গলা ফুলিয়ে ডাকছে, আয়নায় নিজেকে দেখে প্রতিপক্ষ ভেবে আক্রমণ করতে চাইছে, এমন দৃশ্য দেখতে ভালােই লাগে।

পােষা পুরুষ কোড়াও আয়নায় নিজেকে দেখে প্রতিপক্ষ ভাবে, আক্রমণ জেব্রা ফ্রি ইত্যাদি। এই সব বিদেশি পাখি বহু বছর যাবৎ খাচায় থাকতে থাকতে, বংশ বৃদ্ধি করতে করতে এখন খাঁচায় একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খাঁচার পাখি নামেই এরা খ্যাত। এক জার্মান দম্পতিকে আমি পাখির দোকান থেকে একজোড়া লাভ বার্ড ও একজোড়া জাভা স্প্যারাে কিনে ঢাকার আকাশে উড়িয়ে দিতে দেখেছিলাম।

ওই দম্পতি আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু চারটি পাখিকে মৃত্যুর দরজায়ও ঠেলে দিয়েছিলেন। খাচায় জন্মগ্রহণ করা পাখি-যে কিনা খাচার ভেতরেই বড় হয়েছে, তার পক্ষে বাংলাদেশ নামক এই বিদেশের প্রকৃতিতে কোনােভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কাক-চিলে যদি নাও ধরে তবুও মরবে ওরা অনাহারে। এ ধরনের বন্দি পাখিকে মুক্ত করে দেয়ার বিপদও কম নয়।

খ) সুখ ও জীবিকার জন্য : 

এককালে গ্রাম-বাংলার অনেক মানুষ ক্ষেতখামারের কাজের অবসরে পােষা পাখি দিয়ে বুনাে পাখি শিকার করে বিক্রি করত। এটা ছিল শখের পাশাপাশি টাকা রােজগারের একটা উপায় । তখন পাখিও প্রচুর ছিল, শিকারও মিলত দেদার। তারা সাধারণত পুষত দু'তিন প্রজাতির ঘুঘু, ডাহুক, কালিম, কোড়া, বুলবুল ইত্যাদি। উল্লিখিত পাখিদের পুরুষগুলােই পােষা হত।

ওদের পুরুষগুলাে তার রাজত্বে অন্য কোনাে অচেনা পুরুষ দেখলেই আক্রমণ করতে আসে। এসেই পড়ে যায় ফাঁদে। সরু সরু বাঁশের লগি-একটার পেছনে আরেকটি লাগিয়ে পােষা ঘুঘুকে খাচা সমেত তুলে দেয়া হয় কোনাে গাছে। পােষকের শিস শুনে বা এমনিতেই ঘুঘুটি ডাকতে শুরু করে। বুনাে ঘুঘু এসে খাঁচার সামনে যেই বসতে যায়, অমনি সে পাত্র জালের ফাদে বন্দি হয়ে যায়। আর ঘুঘুর ফাদ যে কী জিনিস! “ঘুঘু দেখেছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখাে নি' কথাটির উদ্ভব কী এমনি এমনি হয়েছে। ডাহুক, কোড়া, কালিমের ক্ষেত্রেও এ রকমটি ঘটে। তবে খাঁচা ছাড়াও ডাহুক, কোড়া ও কালিম পাখি শিকার করতে দেখেছি আমি।

ডাক শুরু করতেই বা পােষা পাখিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে আসে বুনােপাখি, লেগে যায় মারামারি। পায়ে পায়ে আঁকড়ে ধরে পরস্পরকে। তখন পােষক দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলে বুনাে পাখিটিকে। ডাহুক, কোড়া ও কালিম আজো পােষা হয় গ্রাম-বাংলায়, তবে শিকার মেলে খুব কম। ঘুঘু, বিশেষ করে তিলাঘুঘু পােষার প্রচলন আজো যথেষ্ট আছে, শিকারও বেশ মেলে। শহর বন্দরে একটু বেশি দামে বিক্রি হলেও গ্রামগঞ্জে এ রকম। একজোড়া ঘুঘু ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়।

বাংলাদেশের পাখি : মাছরাঙ্গা
বাংলাদেশের পাখি : মাছরাঙ্গা

পাখি পােষার প্রবণতা কাদের বেশি : 

শিশু-কিশােরদের ভেতরই পাখি পােষার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। গ্রাম-বাংলার শিশু-কিশােরেরা আজো পাখির বাসা দেখে রাখে, নজরে নজরে রাখে, সময় মতাে পাখির ছানা এনে খাচা বন্দি করে ফেলে। বড়দের ভেতর যেমন মহিলাদের পাখি পােষার শখ বেশি, তেমনি শিশু-কিশাের বয়সীদের ভেতর মেয়েদের পাখি পােষার শখ একেবারেই কম লক্ষ করা যায়। |

কীভাবে পােষার জন্য পাখি সংগ্রহ করা হয় : গ্রাম-বাংলায় পাখি সংগ্রহ করা হয় পাখির বাসা থেকে। পােষা পাখি বড় হলে কেনাবেচার রেওয়াজও আছে। পােষকের শিস শুনে ডাকতে শুরু করে যে ঘুঘু, ডাহুক, কালিম ও কোড়া, তাদেরকে বলা হয় 'শিকারি'। শিকারি ঘুঘু, ডাহুক, কোড়া চড়া দামে। বিক্রি হয়। পােষার জন্য পাখি বা পাখির বাচ্চা কেনার জন্য (বাংলাদেশের পাখি) ১৫ দিনব্যাপী একটা বাজার বসে কিশােরগ জেলার কটিয়াদী থানায়।

সবাই বলে ‘পাখির মেলা', হিন্দু সম্প্রদায়ের রথের মেলার শুরুতেই শুরু হয় ওই পাখির মেলা, জমজমাট হয় উল্টোরথের দিনে। ২০০০ সালে ওই পাখির মেলায় গিয়েছিলাম আমি। শুধু পাখি নয়, পােষা পাখির জন্য খাঁচার মেলাও বসে আলাদাভাবে। বাহারি সব খাঁচা। দামও ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। ভােগবেতাল গ্রামের ওই রথের মেলায় দেখেছিলাম ময়না, গাে-শালিকের বাচ্চা, কোড়ার বাচ্চা, বকের বাচ্চা ও হলদে বউয়ের বাচ্চাসহ আরাে অনেক পাখি।

কেনাবেচা হচ্ছিল ভালােই। ওই পাখির মেলা ঘিরে ওই এলাকার শিশু-কিশােরেরা বেশ আগে থেকেই নানান রকম পাখির বাসার খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করে, পাখির ছানা নিয়ে মেলায় যায় বেচতে। অনেক মানুষ পােষার জন্য ওই মেলায় পাখি কিনতে যায়। এখানে শখ ও জীবিকার আশ্চর্য সমাহার দেখা যায়। ২০০৮ সালের মেলায়ও গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশে কী কী পাখি পােষা হয় বাংলাদেশে বিদেশি বাদ দিলে সাধারণত পােষা হয় ময়না, শালিক, ঘুঘু, টিয়া, ডাহুক, কালিম, কোড়া, ডুংকর, বুলবুল, মুনিয়া, হলদে বউ, শ্যামা ইত্যাদি। হাঁস-মুরগি-তিতির (আফ্রিকান গিনি ফাউল) কবুতরও কিন্তু পাখি।

যেসব রাজহাঁস বা অন্য হাঁস ও কবুতর পােষা হয়, ওদের আদি পিতা-মাতারা কিন্তু আজো বুনাে রয়ে গেছে। যেমন, দুনিয়ার সব পােষা মােরগ-মুরগির আদি পিতা-মাতা হচ্ছে লাল বনমােরগ ও মুরগি (রেড় জঙ্গল ফাউল) যেটা আজো বাংলাদেশের সুন্দরবনে, সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড় টিলাময় জঙ্গলে যথেষ্ট আছে। হাসেদের আদি পিতা-মাতারাও প্রতি বছর অতিথি হয়ে আমাদের দেশে আসে। আর দুনিয়ার সব পােষা কবুতরের আদি যে পিতা-মাতা, সেই বুনাে কবুতর বা জালালী কবুতর (রু রক পিজিয়ন) বাংলাদেশে তাে বটেই, ঢাকা।

বাংলাদেশের পাখি : ঘুঘু


শহরেও প্রচুর আছে। সুন্দরবনের বন মুরগির ডিম পােষা মুরগির তায়ে বসিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে পােষার চেষ্টা আমি কিশাের বয়সে বেশ ক'বার করেছিলাম। সুন্দরবন থেকে ধরে আনা ছানাও পোষার চেষ্টা করেছিলাম, সচল হই নি। বুনাে কবুতরকেও পােষ মানানাে অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় পােষা পাখি হচ্ছে কবুতর। কবুতর শাস্তির প্রতীক। বাংলাদেশে যত কবুতর পােষা হয়, সে তুলনায় অন্য পাখি একেবারেই নগণ্য।

মানুষ কেন পাখি পােষে: পাখি পােষা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। বলা যায়। জন্মগত প্রবৃত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পাখি পুষে আসছে। একদিন যা ছিল নেশা, ক্রমে ক্রমে তা পেশায় পরিণত হয়। পাখির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই মানুষ পাখি পুষতে শুরু করেছিল। মােগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিল একটি পক্ষীশালা। সেখানে ছিল বহু দেশি-বিদেশি পাখি। তিনি নিয়মিত ওইসব পাখির আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন।

বর্তমান যুগে পাখি বিজ্ঞানীরাও কিছু কিছু পাখি পোষেন গবেষণার জন্য। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে শিকারি পাখিদের পােষা শুরু হয়েছিল। ঈগল-বাজরা মুক্ত অবস্থায় খরগােশ, অন্যান্য পাখি ও ছােট ছােট প্রাণী শিকার করত, আজো তা করে। বাংলাদেশের দু'তরুণের কথা আমি জানি, যাদের একজন একটি বাজ পুষেছিল, পরে ছেড়েও দিয়েছিল। অন্যজন এখনাে পুষছে একটি ঈগল। অভিজাত শ্রেণীর লােকজন এক সময় বুলবুল পুষত। মােরগ লড়াইয়ের মতাে বুলবুলির লড়াইও এক সময় জনপ্রিয় খেলা ছিল এই বাংলায়।

পাখি পোষা কি উচিত । এই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্কে গেলে কোনাে পক্ষই জিততে পারবে না সহজে। মানুষ পাখি পােষে নানা আকর্ষণে। কিছু পাখি মানুষের কিছু কথা নকল করতে পারে, যাদেরকে বলা হয়, কথা বলা। পাখি। এ দলের পাখিদের মধ্যে ময়না ও টিয়াই পড়ে প্রথমে এবং এই দুটি পাখিরই ছানা সংগ্রহ করা হয় নির্মমভাবে মা-বাবার কোল খালি করে ছিনিয়ে আনা হয় ওদের। ছানাদের শােকে কিন্তু মা-বাবারা কাদে, ছানারাও কাঁদে মা-বাবার শােকে।

তিলা ঘুঘু বাচ্চার শশীকে দুতিন দিন পর্যন্ত করুণ সুরে কাদে, খাঁচাবন্দি বাচ্চাদের আশপাশে অস্থির ওড়াউড়ি করেও কাঁদে। অনেক শিশু-কিশাের বাজঈগল পােষে শখের বশে। কিন্তু এটাতাে উচিত কাজ নয়। বরং শিশু-কিশােরেরা স্কুলভিত্তিক, পাড়া ভিত্তিক বা এলাকা ভিত্তিক “ভালােবাসি পাখি’ (লাভ বার্ড) ক্লাব ‘ভালােবাসি বন্যপ্রাণী' (লাভ ওয়াইল্ড লাইফ) ক্লাব বা বন্যপ্রাণী রক্ষা ক্লাব (ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাব) গঠন করে পাখি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

যারা পাখির বাসা নষ্ট করে, পাখির ছানা সংগ্রহ করে নিজে পােষার জন্য বা বিক্রির জন্য, তাদের বুঝিয়ে নিবৃত করতে পারে। এর মাধ্যমে শিশু-কিশােরেরা একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণের অনাবিল আনন্দ যেমন লাভ করতে পারে তেমনি পারে পাখিবন্ধুদের উপকার করতে। পাখিরা হচ্ছে প্রকৃতির উড়ন্ত দুরন্ত সুন্দর। ওরা প্রকৃতির বন্ধু । মানুষের বন্ধু পাখি। তাদের বন্দি করে পােষা উচিত নয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url