বাংলাদেশের পাখি : বুলবুল

বাংলাদেশের পাখি বুলবুল
বাংলাদেশের পাখি : বুলবুল 

কলাবাগানের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি মেছােঈগল। কলার পাতায় বসা বুলবুলটি উত্তেজিত কণ্ঠে ডেকে উঠল। ধেয়ে গেল ঈগলের পেছনে পেছনে। কলার কাদির ভেতরের বাসায় ডিম পেটের তলায় রেখে বসেছিল স্ত্রী বুলবুল, সেও বাসা ছেড়ে কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে ডাকতে ধাওয়া করল ঈগলকে। দু'টি বুলবুল পাখি ধাওয়া করেছে বড়সড় এক ঈগলকে, ঈগল পালাচ্ছে দ্রুত, মজার দৃশ্যই বটে ! দৃশ্যটি আরও মজাদার হল তখন, যখন দু’টি বুলবুলই ওপর থেকে ডাইভ মেরে ঠোট চালায় ঈগলের পিঠে, ঈগল সঁই করে উঠে যায় ওপরে, তখন নিচে থেকে যেই না ধেয়ে যায় আবার বুলবুল দু’টি, ঈগল যেন ঝাপ দিয়ে নিচে নামে। তারপর খাল পাড়ি দিয়ে দূরে চলে যায় দ্রুত। বুলবুল দুটি শত্রুকে তাড়িয়ে দিতে পারার আনন্দে, শূন্যেই ধেই ধেই নাচতে নাচতে, ডাকতে ডাকতে ফিরে আসে কলাগাছে। স্ত্রী আবার বাসায় শরীর ডুবিয়ে বসে যায়।

এবার ধরা যাক সেই অসাধারণ সুন্দর ‘দুধরাজ বুলবুলটির কথা, সুন্দরবনের এক হরিণের পিঠে চড়ে সুখ-দোলা খাওয়ার পাশাপাশি ৬৩ত পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ খাচ্ছিল। খাল পাড়ে ছিল একটি মেছােবিড়াল। হার বাচ্চা কিংবা হরিণকে আক্রমণ করার কোনাে ইচ্ছেই ওর ছিল না। ও যাণে জলে তাকিয়ে মাছ খুঁজছিল। যেই না পড়ে গেল ও দুধরাজের নজরে, অমনি দুধরাজ উত্তেজিত কণ্ঠে ডেকে উঠেই হরিণের পিঠ ছাড়ল, অসম সাহসিকতায় চলে গেল হরগােজা ঝােপের মাথায়, ডাইভ মারল মেছােবিড়ালের মাথার ওপরে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মেছােবিড়াল, যার আকার প্রায় চিতাবাঘের মতাে, সে লাফ দিয়ে বেরিয়েই ছুটতে শুরু করল ঘন বনের দিকে। লম্বা লম্বা লাফে ঘন জঙ্গলে পৌছানাের আগে সে দুধরাজের ঠোক্কর খেল ছয় বার, হরিণের পাল। মাথা তুলে নিশ্চল। শত্রুকে তাড়িয়ে দিয়ে সুন্দর ওই বুলবুল ফিরে এল খােশমেজাজে, বসল একটি হরিণের পিঠে। এদেরই আরেক জাতভাই, যার নাম সিপাহি বুলবুল, যে একটি হামজুম গাছের মাথায় লাফিয়ে লাফিয়ে পাকা পাকা ফল খাচ্ছিল। যেই না তার নজরে পড়ল একটি কুকোপাখি, যে মাটি ধরে হেঁটে আসছে, সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিতভাবে ডাকতে ডাকতে, লম্বা ঝুঁটি নাচাতে নাচাতে গেল তেড়ে। সুপারিগাছের কাদির ওপরের বাসা থেকে ঝাপ দিল স্ত্রী পাখিটিও, তারপর দু’জন মিলে কুকোকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। মাটি ধরে, ঝােপঝাড়ের তলা দিয়ে ছুটেও কুকো রেহাই পেল না, কম করে ১২টি ঠোকর হজম করে সে লুকিয়ে পড়ল একটি ঘন ঝােপের তলায়। সিপাহি বুলবুল দু’টি খুশি মনে ফিরে এল আবার আগের জায়গায়। এদেরই আরেক জাতভাই কালাে বুলবুল। বাসার ত্রিসীমানায় কোনাে শিকারি পাখি বা প্রাণী দেখলেই চরম সাহসে তেড়ে যায়। শত্রুকে এলাকা ছাড়া করে তবেই ফেরে।

উপরের ঘটনাগুলাে থেকে পরিষ্কার বােঝা গেল, উল্লিখিত ৪ রকমের বুলবুলই দুঃসাহসী পাখি। একমাত্র দুধরাজ (শাহ বুলবুল) ছাড়া অন্য ৩ প্রজাতি বাসা বা ডিম-বাচ্চা না থাকলে কিন্তু এভাবে শত্রুকে তাড়ায় না। দুধরাজ বাসা না থাকলেও শত্রুকে ধাওয়া করে, চেঁচিয়ে আশেপাশের সবাইকে সতর্ক করে দেয়। সুন্দরবনে সে হরিণ ও শূকরের পিঠে বসে, বুনাে খরগােশের মাথায় বসে। বাঘ, মেছােবাঘ, অজগর, কুমির, সাপ দেখলেই সে সতর্ক সঙ্কেত দিয়ে দেয়, ধেয়ে যায়, যা পরােক্ষভাবে উল্লেখিত প্রাণীগুলােকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে। সুন্দরবনে আমি তাকে বানরের দলের পেছনে পেছনে উড়তে দেখেছি। ডাল-পাতায় ঝাকুনি লেগে পােকামাকড় উড়লেই সে চমৎকার ভঙ্গিতে ধেয়ে গিয়ে ওগুলােকে ঠোটে চেপে ধরছিল। আবার মৌচাকের আশেপাশে ঘুরঘুর করে মৌমাছি খাচ্ছিল।

আমাদের দেশে স্থায়ীভাবে বাস করে ৮ রকমের বুলবুল। আর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানান রকমের বুলবুল। এর ভেতরে সবচেয়ে ছােটটি লম্বায় মাত্র ১৪ সেন্টিমিটার, বড়টি হচ্ছে ২৮ সেমি.। এখানে একটু কথা তা বুলবুলরা হচ্ছে পাইকনােনােটিডি (Pycnonotidae) গােষ্ঠীর পাখি। দুধরাজ তাই এ দলে ফেলা হয় নি। আবার সবুজ সবুজ বুলবুল যাদেরকে আমরা বলি পাতা-বুলবুল বা হরবােলাও বলি, তারা হচ্ছে ইরেনিডি (Irenidas গােষ্ঠীভুক্ত। পাশাপাশি দুধরাজ বা শাহ বুলবুল হচ্ছে মাসকিকাপিডি (Muscicapidae) গােষ্ঠীর পাখি। গােষ্ঠী আলাদা হলেও এরা সবাই বলব বলেই পরিচিত। তাই দুধরাজ হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বুলবুল (পরুষটি। যার সুন্দর লেজটাই (দুটো লম্বা পালকসহ) লম্বায় ২৮-৩১ সেমি.। আর লেক বাদে সে প্রায় ১৮ সেমি.। সব মিলে সে প্রায় ৪৯ সেমি.। সে শুধু লমাতেই বড় নয়, সৌন্দর্য বিচারেও সে দুনিয়ার সেরা বুলবুল। এমনকি দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর পাখি সে। পাশাপাশি সিপাহি বুলবুলও দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর। বুলবুল। বিদ্রোহী কবি সম্ভবত এই বুলবুলকে দেখেই লিখেছিলেন, বাগিচায়। বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস নে আজি দোল।

শুধু বিদ্রোহী কবি নন, বুলবুল শিল্প-সাহিত্য-গান-কবিতায় বহুল ব্যবহৃত একটি নাম। কাব্যগাথায় অমর পাখিদের ভেতর বুলবুল অন্যতম। 

এবার সংক্ষেপে বুলবুলদের পরিচয় তথা স্বভার-চরিত্র সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। দুনিয়ার আশি ভাগ বুলবুল চরম সাহসী। তেত্রিশ ভাগ ভাল গায়ক। বাষট্টি ভাগ মােটামুটি গায়ক। বাসা-ডিম-বাচ্চা না থাকলে অধিকাংশই শত্রুকে ধাওয়া করে না। ডিমের সংখ্যা ২–৪টি। প্রায় ক্ষেত্রেই রঙ সাদা, ঘিয়ে অথবা সাদা ক্রিমের মতাে। স্ত্রী-পুরুষ মিলে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪-১৮ দিনের ভেতরে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১০-১৬ দিনের ভেতর। অনেকে একই বাসায় দু'বার ডিম-বাচ্চা তােলে। অথবা কম সময়ের ব্যবধানে নতুন বাসা বাঁধে। অবশ্যই আগের বাচ্চাগুলােকে স্বাবলম্বী করার পর। বাসা বাধতে সময় লাগে ৩-৭ দিন। প্রায় সবাই চঞ্চল। ঝটি আছে অধিকাংশের। ডানা। খাটো থেকে মাঝারি। ঠোটও তাই। সবচেয়ে লম্বা ঝুঁটি হচ্ছে প্রায় ৪ সেমি.। আমাদের সিপাহি বুলবুল সেই দলে। সবার ঠোট ২-৩ সেমির ভেতরে। ঠোট নিচের দিকে সামান্য বাঁকানাে। পা খাটো। ঘাড়ও খাটো। ঠোট নলাকৃতির। অধিকাংশের শরীরে আছে বাদামি, ছাই, লাল ও হলুদসহ সাদা রঙ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই। অধিকাংশ বুলবুল লেজের তলাটা লাল। অনেকের হলুদ অথবা সাদা। দুনিয়ায় একটি মাত্র বুলবু আছে, যার লেজের তলাটা কালাে। অধিকাংশের ওড়ার ভঙ্গি এক। ওড়ার ক্ষেত্রে এরা দুর্বল। ডানা যখন বুজায়, তখন মনে হয়, ক্ষণিকের জন্য শূন্যে। থমকে দাড়াল, ডানা মেললেও অনেক সময় ওরকম মনে হয়। কিছুটা দুলেদলে ওড়ে। সবারই খাদ্য তালিকা, বাসার আকৃতি একই। আমি সিপাহি বুলবুলকে ফুলের টবের ফুলগাছে, কলার মােচার ওপরে এমনকি একবার পদ্মফুলের ভেতরে বাসা করতে দেখেছি। সে বাসার বাচ্চা পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল। বাসা বাধার ক্ষেত্রে এদের কোনাে বাছবিচার নেই। জনবহুল শহরের নিচু গাছ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক বনসহ গ্রামীণ জঙ্গলের যে কোনাে গাছে, উঁচু বা নিচুতে বাসা করে এরা। অনেকেরই গোফ বা দাড়ির মতাে অতি সুক্ষা। পালক আছে। এবার সংক্ষেপে বাংলাদেশের বুলবুলির কথা বলছি। 

লালপুচ্ছ বুলবুল
লালপুচ্ছ বুলবুল (Red Vented Bulbul)


১. লালপুচ্ছ বুলবুল (Red Vented Bulbul) : লড়াইবাজ পাখি হিসাবে। এক সময় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ছিল এর। ইরান-ইরাক-আফগানিস্তানের কোথাও কোথাও আজও এই বুলবুলদের লড়াই হয়। বাংলাদেশে এখন বােধ হয় আর। হয় না। তুখােড় লড়াকু এরা, দুঃসাহসী। লেখার শুরুতে এরই কথা বলা হয়েছে। পােষা অবস্থায় তাে বটেই, বুনাে অবস্থাতেও এই লড়াইয়ে (পুরুষেরা) মেতে। ওঠে কখনাে কখনাে। লড়াইয়ের সময় এরা মাটিতে নামে। লড়াইয়ে এতই মত্ত থাকে যে, শিকারি প্রাণীদের কবলে পড়ে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pycnonotus Cafer.

লম্বায় এরা ১৯—২২ সেমি.। মাথায় যেন কদমছাট চুল। উত্তেজিত হলে বা আনন্দিত হলে সামান্য ঝুঁটিমতন জেগে ওঠে মাথার পালক। এদের লেজের তলায় কেউ যেন এক চিমটি সিদুর লাগিয়ে দিয়েছে। লেজের ওপরটায়। চৌকো সাদা ছােপ। ওড়ার সময় ভাল করে দেখা যায়। পিঠ-বুক দেখে মনে হয় সাপের আঁশ। খুব সরু সরু সাদা টান থাকায় এরকম মনে হয়। মাথাচিবুক কালাে। পেটের তলাটা ফিকে সাদা। লেজের ওপরটা কালচে-পাটকিলে, আগায় সাদা সাদা ছিট ও ছােপ। চোখ পিঙ্গল-লালচে। ঠোট ও পা কালচে। শরীরের রঙ সব মিলে খয়েরি-বাদামি। যখন নীরবে গান গায়, তখন শব্দের চমৎকার সুর ওঠানামা করে গলার ভেতরে। বাসা বাধে পছন্দমতন যে কোনাে জায়গায়। পেয়ালার মতাে, ছিমছাম। এরা একই বাসায় মাঝে মাঝে দু’বার ডিম-বাচ্চা তােলে। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ২৫ দিন। ডিম হয় অধিকাংশ সময় ৩টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪–১৫ দিনে। এরাই আমাদের দেশে বেশি আছে। শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে এদেরকে দেখা যায়। ডিম গােলাপি সাদা। তার ওপরে বাদামির ছিট-ছােপ। ঢাকা শহরে প্রচুর আছে। বাসাও করে।

কালাে বুলবুল
কালাে বুলবুল (Black bulbul)


২. কালাে বুলবুল (Black bulbul) : লম্বায় ২৫-২৬ সেমি.। কালাে ঝুঁটি। কিছুটা উল্টোমুখাে ওই ঝুঁটি দেখতে ভাল লাগে। সব মিলে এরা কালাে একটি পাখি। কানের চারপাশ ঘিরে কালাে দাগ, ঠোটের গােড়া থেকে যার শুরু। ঠোট চোখ লাল। পেট সাদাটে। কণ্ঠস্বর মােলায়েম। এরা দলে দলে থাকতে পছন্দ করে। পছন্দ করে গভীর বনবাগান। সুন্দরবনে আছে। এদেরকে লােকালয়ে দেখা যায় শীতে। বাসা ডিম ইত্যাদি লাল পুচ্ছের মতােই। বাচ্চা ফটতে ও উড়তে একই সময় লাগে। এটার বৈজ্ঞানিক নাম Hypsipetes Madagascariensis.

সিপাহি বুলবুল
সিপাহি বুলবুল (Red Whiskered Bulbul)


৩. সিপাহি বুলবুল (Red Whiskered Bulbul) : মস্ত উল্টোখুঁটির এই বুলবুল দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চালচলনে কেমন এক রাজকীয় ভাবআছে। অন্য বুলবুলদের চেয়ে এরাই বােধ হয় বেশি চঞ্চল। কণ্ঠস্বর চড়া। তবে, গান গাইবার সময় কণ্ঠে মিষ্টি সুরের ওঠা-নামা আছে। চোখের নিচে এক চিমটি সাদা। ঝুঁটি ও মাথা কালাে। গলা, বুক, পেট ও লেজের তলার প্রান্ত সাদা। এদের লেজের তলায় এক চিমটি সিঁদুর। ডানা বুজানাে অবস্থায় উপরিভাগটা বাদামি। পা কালাে। চোখ পিঙ্গল। ঠোট-পা কালাে। দারুণ ফুর্তিবাজ এরা। চেহারায় রাগীরাগী ভাব। দেশের অনেক এলাকায় এদেরকে ‘ঝুঁটি বুলবুল’ বলা হয়। বাগেরহাটে বলা হয় ‘ঝুটকুলি’। কুলি অর্থ হচ্ছে বুলবুলি। কোথাও কোথাও এদেরকে পাহাড়ি বুলবুল বা চায়না বুলবুলও বলা হয়। ডিমের সংখ্যা, বাসার আকার ও ডিম লালপচ্ছ বলবলের মতােই। তবে, এদের ডিমের রঙ চকচকে ফিকে গােলাপি। তাতে থাকে লালচে বাদামি ছিট। এরা মােটেও ঝগড়াটে নয়, লড়াইও করে না সহজে। এর বৈজ্ঞানিক নাম PycnOnotus Jocosus.

কালো মাথা হলুদ বুলবুল
কালো মাথা হলুদ বুলবুল (Black-headed Yellow Bulbul)


8. কালো মাথা হলুদ বুলবুল (Black-headed Yellow Bulbul): খুবই সুন্দর পাখি। ১৮—২০ সেমি. লম্বা। চমৎকার কালাে ঝুটি, কিছটা। উল্টোমুখাে, খাড়া। কালাে ঠোট, মাথা, ঘাড় ও ঠোটের ভেতরে চকচকে হলুদ চোখ আর কালচে চোখের মণি দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। বুজানাে অবস্থায়। ডানার ওপরটা হাল্কা হলুদাভ সবুজ। ঘাড় ও পিঠ লালচে সবুজ। বুক-পেটলেজের তলা চমৎকার হলুদ। লেজের ওপরে সরু সাদা টান। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। এদের ডিমের সংখ্যা, বাসার গড়ন ও ডিম ফোটার সময় আগের বুলবুলদের মতােই। দু জনেই ডিমে তা দেয়। এরা একটু লাজুক। বৈজ্ঞানিক নাম Pycnonotus atriceps.

শাহ বুলবুল
শাহ বুলবুল (Paradise Flycatcher)


৫. শাহ বুলবুল (Paradise Flycatcher): সত্যিই যেন এরা স্বর্গের এক পাখি। অপূর্ব এদের সৌন্দর্য। লেজের লম্বা দু’টি পালক যেন সাদা দু'টি ফিতা, যে ফিতার মাঝখানে কালাে রেখার টান। ধাতব সাদা লেজ রােদে যেন জ্বলে, ঝলমল করে। মখমলের মতাে নরম পেলব ওই লেজের লম্বা ফিতা। ওড়ার সময় বাতাসে ছন্দে ছন্দে দোলে, মনে হয় শূন্যে যেন সাদা রঙ ছিটাতে ছিটাতে উড়ে যাচ্ছে ও। উল্টো বাতাসে উড়লে লেজ টানটান থাকে, বাতাসের প্রতিকূলে উড়লে লেজের পালক দুটি গােল হয়ে পিঠ, এমনকী মাথার ওপরে এসে পড়ে। অথবা পেটের তলায় একটি সাদা বৃত্ত তৈরি করে। তখন যা চমৎকার লাগে না ! লেজের চমক-ঠমক ও বাহারে এরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ পাখি। বাসা, ডিম-বাচ্চা হবার পরে আনন্দে এরা লেজের পালক পিঠের ওপরে তুলে ঘুরে ঘুরে নাচে, মাথার ঝুঁটি নাড়ে। তখনাে দেখতে দারুণ। লাগে। উড়ে যাবার সময় দেখলে মনে হবে, একটি সুন্দর স্বপ্ন যেন চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে দিয়ে, এমন কেবল তাদেরই মনে হবে, যারা দুধরাজ (পুরুষটি) পাখি দেখেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দুধরাজ পাখি দেখে নি। না দেখার কারণ, সংখ্যায় এরা কম। অতিশয় চঞ্চল, ঘুরে বেড়ানো এদের স্বভাব। বাসা না বাধলে পুরুষটি এক জায়গায় থাকে না। পুরুষের ঘাড়-মাথা, মাথার ঝুটিসহ গলা-বুক কালাে। পিঠ সাদা। বুজানাে অবস্থায় পিঠের নিচের দিকে কালচে কালচে মােটা সরু টান আছে। চোখ চকচকে নীল। চারপাশটা বাদামি-লালচে। এদের স্ত্রী পাখিটির ঝুঁটি বেশি লম্বা, তবে চওড়ায় কম। পেটের দিকটা সাদা। পিঠ বাদামি। অল্প বয়সী পুরুষের রঙ অনেকটা স্ত্রী পাখির মতাে, তবে লেজের ফিতা থাকে কিন্ত রঙ থাকে লালচেবাদামি। বাবার পাশে ছেলেকে দেখে অনেকে স্ত্রী বলে ভুল করে। কিন্তু স্ত্রী পাখির লেজের লম্বা পালক থাকে না।বৈজ্ঞানিক নাম Terpsiphone paradisi.

এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। বুলবুলদের মধ্যে এরাই বেশি চেঁচায়। ছায়া ঢাকা বনবাগান এদের পছন্দ। সুন্দরবনে বেশ আছে। ডিম হয় ৩–৫টি। ডিম ফোটে ১৫-১৮ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১৭-২০ দিনে। চমৎকার বাসা বুলবুলদের ভেতরে এরাই করে। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিমের রঙ ফিকে গােলাপি। হলদেটে ভাব থাকে। লালচে বাদামি ছিট থাকে। পুরুষ পাখি ডিমে তা কম দেয়।

এ ছাড়াও আমাদের দেশে আছে দু'রকম পাতা বুলবুল (Green Bulbul) বা হরবােলা। এরা কণ্ঠে অন্য অনেক পাখির সুর বা ডাক নকল করতে পারে। এদের রঙ পাতা সবুজ। ঠোট-বুক কালাে। সুন্দরবনসহ সিলেট-চট্টগ্রামের জঙ্গলে আছে। গলা নীল। কপাল হলদেটে। বুজানাে ডানার গােড়া চকচকে নীল। স্ত্রী পাখির গলায় থাকে কালাে বলয়। দু'রকম হরবােলার ভেতর সামান্য পার্থক্য আছে। এদের মাথায় ঝুঁটি নেই।

এ ছাড়াও শীতে আমাদের দেশে বেড়াতে আসে বেশ ক'রকম বুলবুল। যার ভেতরে সাদা গলা (White checked Bulbul) উল্লেখযােগ্য। এদের লেজের নিচে এক টিপ হলুদ। কানের চারপাশটাই চকচকে সাদা। এ ছাড়াও বাদামি কান, কমলাপেট, রুফাসবেলীড, শীতে আমাদের দেশে দেখা যেতে পারে।

বুলবুলরা খায় পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ফুলের মধু ও নরম পাপড়ি, তাল-খেজুরের রসসহ বিভিন্ন রকমের ফল। কেউই মাটিতে নেমে হাঁটতে পারে না। লাফাতে পারে। প্রায় সবাই পােষ মানে। বুলবুল উপকারী পাখি। বাংলাদেশে ওরা ভালই আছে। ভাল থাকুক চিরকাল।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url