বাংলাদেশের পাখি : নীলটুনি

বাংলাদেশের পাখি  নীলটুনি
বাংলাদেশের পাখি : নীলটুনি

শীত চলে গেছে, বসন্ত এসেছে। ফুরফুরে দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করেছে। ওই বাতাসে দোল খাচ্ছে রক্তজবা ফুলগুলাে। একটি ফুলের সামনে স্থির। উড়ছে সুন্দর এক কালাে প্রজাপতি। দুপুরের রােদ পড়েছে ওর পাখায়, ধাতব দ্যুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। বহু রকম প্রজাপতি তুমি দেখেছ, এমন লম্বাটে ও সুন্দর কালাে প্রজাপতি আগে আর দেখাে নি। দেখাে নি এমন লম্বাটে। ঠোট। নুয়ে পড়া ফুলের সামনে হােভারিং (শূন্যে স্থির থেকে ওড়া) করছে। কালাে প্রজাপতি, লম্বা ঠোট ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বার বার। তুমি। আকৃষ্ট হলে, কৌতূহলী হলে, এগিয়ে গেলে ফুল গাছের দিকে। কাছাকাছি যেই না তুমি গিয়েছ, অমনি কালাে প্রজাপতি হয়ে গেল সুন্দর কালাে এক ছােট পাখি, তােমাকে চমকে দিয়ে, মুগ্ধ করে দিয়ে সে উড়ে গিয়ে বসল নারকেল গাছের মাঝখানের সরু পাতাটির শীর্ষদেশে। আনন্দে গান গেয়ে উঠল ‘হুইউই..চি হি হি... হুইচো ... ইচিইট’...।

ওর গান শুনেও মুগ্ধ হলে তুমি। কী মিষ্টি গলা ! ছােট পাখি, অথচ গলার। জোর বেশি। মােলায়েম গলা, যেনবা একটু আগে মাখন খেয়ে নিয়েছে। তুমি মুগ্ধ চোখে দেখছ ওকে, শুনছ মিষ্টি গান। হঠাৎ সে উড়ে চলে গেল গাছগাছালির। মাথার ওপর দিয়ে। দ্রুতবেগে।

তােমরা চিনে ফেললে নাকি ওই পাখিটিকে? যারা চিনলে না তাদের কাছে আমি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। ধাধাও বলতে পারাে। কোন ছােট পাখি গেরস্থ বাড়ির আঙিনা ছাড়া অন্য কোথাও বাসা বাঁধে না? তােমরা অনেকেই জবাব দিয়ে ফেলবে চড়ুই। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, বাড়ির আঙিনার গাছপালা ছাড়া অন্য কোথাও বাসা করে না বাংলাদেশের কোন ছােট পাখি ? এবার জবাব দিতে পারবে কি? খুব ভাল পাখি পর্যবেক্ষক না হলে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুবই কঠিন। জবাব হচ্ছে, নীলটুনি। নীলটুনিকে দুর্গা টুনিও বলা হয়। ইংরেজি নাম Purple Sunbird. বৈজ্ঞানিক নাম Nectarinia asiatica. বাংলাদেশের এই-ই একমাত্র পাখি, যে গেরস্থ বাড়ির আঙিনার বরই, ডালিম, লাউয়ের ডগা বা মাচানের কঞ্চি ছাড়া অন্য কোথাও বাসা করে না। রাতে আশ্রয়ও নেয় বাড়ির আশপাশের গাছপালায়। রাতে আশ্রয়ের জন্য তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হচ্ছে পেঁপে পাতা। নলের মতাে ডগাটার শেষ প্রান্তে সে বসে থাকে আরামে, মাথার ওপরে থাকে ছাতার মতাে পাতা। বৃষ্টি ও শিশির থেকে রক্ষা পায় সে। যে পাতাটি নিচের দিকে সামান্য নুয়ে থাকে সে পাতাটিই পছন্দ করে বেশি। তােমাদের কারাে বাড়ির গাছে যদি ওদের বাসা হয়, তাহলে রাতে আশপাশের পেঁপে গাছের পাতার নিচে অবশ্যই খুঁজে পাবে ওদের, টর্চের আলােয়ও ভয় পাবে না। তবে বাসায় যদি ডিম অথবা কম বয়সি বাচ্চা থাকে তাহলে শুধু পুরুষটিকেই দেখতে পাবে। টর্চের আলােয় সে কুচকুচে কালাে। দিনের বেলায় সে কালাে বটে, তাতে লেগে থাকবে বেগুনি হালকা আভা। শরীরে রােদ পড়লে মনে হবে কালাে শরীরে সে এইমাত্র মাখন ঘঁষে নিয়েছে, আবার বড় কোনাে গাছের ছায়ায় থাকলে একেবারে কালােই লাগবে। এই যে কালাে পাখি, সে পুরুষ। বাংলাদেশের ছােট পাখিদের দলভুক্ত সে। কালাে যে কী রকম সুন্দর হতে পারে তা একে দেখলেই বােঝা যায়। বাংলাদেশের সুন্দর পাখিদের নাম বলতে গেলে তার নাম অবশ্যই আসবে। তবে, নীলচে বেগুনির মিশ্রণে এই যে কুচকুচে কালাে রঙ, তা কিন্তু কেবল দেখা যায় বাসা বাঁধার মৌসুমে। বাসা থেকে বাচ্চারা উড়ে যাবার পর থেকে এই নীলচে বেগুনি ও কালাে রঙ আস্তে আস্তে ফ্যাকাসে হতে থাকে। এক সময় মিলিয়েই যায় বলতে গেলে। শুধু বুকে একটা কালাে চওড়া টান ও ডানার উপরিভাগে কালচে রঙটা থাকে। কিশাের পুরুষ নীলটনির রঙটাও থাকে ওরকম।

পুরুষ এই পাখি ঠোটের অগ্রভাগ থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত লম্বায় ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। শুধু মাত্র ঠোট হচ্ছে ৪ সেন্টিমিটার। সরু ঠোটের অগ্রভাগ সূচের মতাে তীক্ষ্ম, রঙ কালাে, ঠোট আনুভূমিক (নিচের দিকে। বাঁকানাে। অত্যন্ত সরু জিভ নলের মতাে হওয়ায় ফুলের ভেতর থেকে মধ। টেনে নিতে পারে অনায়াসে। ঠোট ফাঁক করে ভালমতাে পরীক্ষা করলে বােঝা যায়— অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খাঁজকাটা আছে, যেনবা দাঁত। যখন বাসা হয়, তখন পুরুষ পাখির রঙ যেন আরও কালাে হয়, দেখতেও হয় বেশি সুন্দর। এমনিতে। তার মাথার চাঁদি হালকা কালাে, তাতে পিঙ্গল রঙ হালকাভাবে মেশানাে। পা কালাে। সে যখন ওড়ে, তখন ডানার তলার পালক দেখা যায় ছােট ওই পালকের রঙ সিঁদুরে লাল, তবে হালকা। সব মিলে সে কালােপাখি। মায়াবী চোখ। অত্যন্ত চঞ্চল। তার মতাে ফুর্তিবাজ চঞ্চল ও গাইয়ে পাখি বাংলাদেশে খুবই কম আছে, আনন্দ-ফুর্তি করার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে। তার। দিনে গড়ে ৫ ঘণ্টা সময় সে গান গেয়ে কাটায়। আর তার গানেই ঝরে পড়ে আবেগ-উচ্ছাস, গানেই বােঝা যায় সে খুব ফুর্তিতে আছে, আনন্দে আছে, তার গান ও ফুর্তি বহুগুণে বেড়ে যায় বাসা হওয়ার পর। আর সে বসতে ভালবাসে যে কোনাে গাছের পত্রশূন্য ডালের শীর্ষদেশে। ডানা ঝাকিয়ে, গলা ফুলিয়ে সে যখন গান গায় তখন দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সে যদি থেমে থেমে না ডেকে দম ধরে একটানা ১০ সেকেণ্ডও ডাকতে পারত তাহলে অবশ্যই বাঁশের বাশির চিকন সুরের সঙ্গে তুলনা করা যেত। সে গান শুরু করে আস্তে, তার পরে বাড়তে বাড়তে ক্লাইমেক্সে পৌছে যায়। ফুলের সামনে হােভারিং করার সময় প্রতি সেকেণ্ডে সে ৭ বার ডানা ঝাপটায়। সে কাঠঠোকরার মতাে ঝুলেও বসতে পারে। তার গানের শব্দ ৮০০ বর্গমিটার। জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বাঁশের আগা বা যে কোনাে গাছের শীর্ষদেশে বসে গান গাইতে সে ভালবাসে। গলা খুলে গান গেয়ে সে আশেপাশের সব পাখিকে যেন জানিয়ে দেয়, আমার বউ বাসা করেছে। ডিম পেড়েছে। ক'দিন পরে বাচ্চা হবে। কী মজা হবে আমাদের!

পুরুষ এই পাখিটি ‘খাও দাও ফুর্তি করাে’ নীতিতে বিশ্বাসী। সে যে আমুদে পাখি তা তাকে দেখলেই বােঝা যায়। বাসা বাঁধার কাজে স্ত্রীকে সে একটুও সাহায্য করে না। উঁচু গাছে বসে গান গায়। আর মাঝে-মধ্যে এসে বাসাটা কতদুর হল তা দেখে যায়। স্ত্রীর সঙ্গে এ সময় সে ফিসফিস করে কী সব কথাও যেন বলে। তারপর আবারও গান গাইতে গাইতে বসে কোনাে গাছে।। বাসায় যখন ডিমে তা দিচ্ছে স্ত্রী, তখনও সে আসে, স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে। আবারও আনন্দে গান গেয়ে উঠে চলে যায় অন্যদিকে। বাসার ভেতরে উকিঝুঁকি মেরেই সে খুশিতে আটখানা হয়। ঝিরঝির করে ডানা কাঁপায়, গলায় তােলে চাপা খুশির আওয়াজ। বাসায় বাচ্চা হলে তখন তার ফুর্তি দেখে কে? উচ গাছের মগডালে বসে সে পালক নাচিয়ে তারস্বরে আনন্দের গান গায়, যেন-বা সে আশপাশের সবাইকে জানাতে চায় কী মজা ! আমার বাসায় বাচ্চা ফুটেছে ! কী সুন্দর তুলতুলে বাচ্চা ! আমি তাদের আদর করব, খাবার মুখে তুলে দেব ! হ্যা, বাচ্চা হবার পর পুরুষ বাচ্চাদের খাওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অথচ বাসা নির্মাণের জায়গা নির্বাচন থেকে বাসা কমপ্লিট করার দায়দায়িত্ব সব স্ত্রীর। বাসা কমপ্লিট করার জন্য স্ত্রীকে ১২০০ বার পর্যন্ত যাতায়াত করতে হয়। নরম উপকরণ দিয়ে বাসা বানায়। পাটের আঁশ, ঘাসফুল, কাশফুল, তুলাে, সরু ঘাস, মাকড়সার জাল ইত্যাদি দিয়ে অত্যন্ত আরামদায়ক বাসা করে। শিমুল তুলাে, ঘাসফুল ভেতরে বিছিয়ে তুলতুলে গদি করে নেয়। ডিম হয় প্রায় ক্ষেত্রে ৩টি। ডিমের রঙ ধূসর। সাদাটে ভাব থাকে। ধূসর অথবা বাদামি কিংবা দু’ রঙেরই ছিট থাকে। ডিম টিকটিকির ডিমের ৩ গুণ বড়। ডিম ফোটে ১৪-১৫ দিনে। বাচ্চারা বাসা ছাড়ে ১৬-১৭ দিনের মাথায়। বাচ্চা ফোটার পরে প্রথম দু’দিনে স্বামী-স্ত্রী গড়ে ২৮০ বার খাবার মুখে বাসায় আসে। পরবর্তী ৫ দিনে গড়ে ১০০০ বার। তার পরবর্তী ৭ দিনে ৮০০ বার। বাকি ৫ দিনে গড়ে ২০০ বার করে আসে। বাসা ছাড়ার পরও বাচ্চারা সপ্তাহ দুয়েক বাবা-মার সাথে সাথে থাকে। এদের বাচ্চারা খুব ছিচকাঁদুনে হয়। ঐ বাচ্চার কান্না শুনে বাসার অবস্থান টের পাওয়া যায়। অবশ্য তােমাদের চোখের সামনেই কিন্তু তার বাসা ঝােলে। তাই একটু খেয়াল করলেই তােমরা ওকে পর্যবেক্ষণ করতে পারাে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই সে আছে, ঢাকা শহরে দেখা যায়। চেনা থাকলে তার গান শুনেই অবস্থান জানা যায়। ঢাকা শহর ও শহরতলিতেও তার বাসা হয়।

এরা যে এলাকা নিয়ে থাকে, সে এলাকায় অন্য নীলটুনিকে আসতে দেয় না। এক গ্রামে তাই ৬/৭ জোড়ার বেশি পাখি দেখা যায় না। বাসা বাঁধার সময় আনন্দে যে গান গায় কোনাে কোনাে পাখি, যাকে বলে বাসা বাঁধার গান’-তা এরা গায়। বাবুই পাখির পরে বাংলাদেশে এরাই শিল্পসম্মত চমৎকার বাসা করে। থলের মতাে ঝুলন্ত বাসা। বসন্তকালে ৬৫%, শীতে ২৩% ও অন্যান্য ঋতুতে ১২%, বাসা। দেখা যায়। ব্যাসা লম্বায় ২০ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার, মাঝখানের ব্যাস ১১ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার, বাসার মুখের ব্যস ৭ থেকে ৯ সেন্টিমিটার হয়। বাসার মুখে ক্রিকেট ক্যাপের মতাে ঢাকনা বা কানিশ থাকে। স্ত্রী যখন ডিমে বসে তা দেয়, সঁচালাে ঠোট বাইরে বেরিয়ে থাকে। পুরুষটি মাঝে মাঝে এসেই বাসার মুখে ঝলে স্ত্রীর। ঠোঁটে ঠোট মিলিয়ে ফিসফিস করে কী সব কথা যেন বলে যায়।

কালাে প্রজাপতির মতাে সুন্দর এই পাখির পাশে তার স্ত্রী কিন্তু একেবারেই বেমানান। আকার একই, দেখতেও একই রকম। রঙ ভিন্ন। স্ত্রীর পিঠ হালকা হলুদ, তাতে বাদামির ছোঁয়া, সব মিলে জলপাই-পাটকেলে। লেজের অগ্রভাগ কালচে। তার কণ্ঠস্বরও কর্কশ। সে তেমন চঞ্চল নয়। তার ওড়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলােমিটার। পুরুষের বেলায় তা ৫০ কিলােমিটার। বাসা বাঁধে। উধ্বে ২৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতায়। ৫০–৭০ সেন্টিমিটার উচ্চতায়ও বাসা করে। নীলটুনি মূলত মধুখেকো। পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ খায়। এরা আম, জাম, জামরুল প্রভৃতি গাছের পরম বন্ধু । ৮-১২ বছর বাঁচে। ফুলের পরাগায়নে এদের জুড়ি মেলা ভার। ফুলের ভেতরে ঠোঁট ঢুকিয়ে যখন এরা মধু খায়, তখন দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। নীলটুনিরা বাংলাদেশে ভালই আছে। এমন কোনাে শহর-গ্রাম নেই, যেখানে দু’চার জোড়া নীলটুনি নেই। এদের আরেক। জাতি ভাইকে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় গ্রামে। ওদের নাম মৌটুসি ওরাও সুন্দর গায়ক পাখি। শরীরের গড়ন, ঠোটের ধরন, খাদ্যতালিকা ও বাসা অভিন্ন। তবে এদের বাসাটি আকারে একটু ছােট হয়। ঢাকা শহরেও এদের বাসা দেখা। যায়। নীলটুনির যেমন স্ত্রী একাই বাসা করে, এদের ক্ষেত্রেও তাই। দু’জাতেরহ। বাসা বাঁধার জায়গা নির্বাচন করতে সময় লাগে ২-৪ দিন। বাসা  তৈরি শেষ হতে সময় লাগে ৪–৭ দিনে। স্ত্রীরা একাই তা দেয়। মৌটুসির ইংরেজি নাম Indian Purple Rumped Sunbird. বৈজ্ঞানিক নাম N. Zeylonica.
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url