বাংলাদেশের পাখি : টুনটুনি

টুনটুনি
বাংলাদেশের পাখি : টুনটুনি

কার্তিক মাস। সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। বনবিড়ালটি ঘুমিয়েছিল বাঁশঝাড়ের গােড়ায়। উঠে দাড়াল। পিঠ নিচু করে ডনবৈঠক কষে নিল। তারপর হাই তুলল। বাঁশঝাড়ের গােড়া থেকে নামল। বাগান পাড়ি দিয়ে চলল গেরস্থ বাড়ির দিকে। মুরগি বা কবুতর শিকারের সুযােগ এ সময়ে মিলে যেতে পারে।

ছােট ছােট ঝােপ, শটিবন ও ঘাসবন মাড়িয়ে সে এগােচ্ছে দ্রুত। একটি লতা-ঝােপের পাশে আসতেই ছােট এক পাখি আচমকা ডাক ছেড়ে শটির ছাড়ল। বসল গিয়ে অদূরে চারা এক আমগাছে। একরত্তি পাখি, কিন্তু চেঁচাচ্ছে তারস্বরে। ছটফট করছে। লেজ দোলাচ্ছে। গলা ফোলাচ্ছে। সে কী উত্তেজনা ওর ভেতরে 

বনবিড়াল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বুক মিশিয়ে ফেলেছে। লতাঝােপের তলায় ঘাপটি মেরেছে পুঁচকে ওই পাখির নজরেই পড়ে নি। শুধুমাত্র লতার টানে শটির পাতায় যে শব্দ উঠেছে তাতেই ভড়কে গিয়ে ছােট ওই পাখি। বাসা ছেড়েছে। অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশে গালাগাল ঝেড়ে চলেছে সমানে।

একটু বাদেই পাখি ডাক থামাল। টুপ করে নামল শটিপাতার ওপরে। ঢুকে পড়ল পাতার মােড়কের বাসার ভেতরে। বসল ডিম বুকে নিয়ে।

বনবিড়াল এগুল ছায়ার মতন। নিঃশব্দে পৌছে গেল জায়গা মতন। তারপর আচমকা ডান থাবা চালাল, পাতা বাসা সমেত টুনটুনিকে চেপে ধরল মাটিতে। প্রথমে খেল ডিম। পরে টুনটুনির মাংস।

টুনটুনি পাখি নিয়ে অনেক মজার ছড়া-কবিতা গল্প লেখা হয়েছে। বাঘকেও একবার ফাঁকি দিয়েছিল টোনাটুনি। ছড়া-কবিতায় টুনটুনিকে যতটা চালাক হিসাবে দেখানাে হয়েছে, আসলে ততটা চালাক সে নয়। বরং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সে বােকার হদ্দ। যেমন— ওই বনবিড়ালের কবলে পড়া। কী দরকার ছিল তাের বাসা ছাড়ার ? বাসা ছাড়লি বলেই তাে বনবিড়ালের পেটে গেলি। অথচ ও যদি সামান্য শব্দে বাসা না ছাড়ত, বনবিড়ালের সাধ্য ছিল না ওর হদিস পায়। এই যে সামান্য শব্দে বাসা ছেড়ে চেঁচামেচি করা, এর ফলে শত্রুর কবলে তাকে পড়তে হয় প্রায়ই। বাসার অবস্থান জেনে ফেলে বেজি, কুকোপাখি, গুইসাপ, দাঁড়কাক ও সাপেরা। বাসা ছেড়েই ওরা এমন করে চেঁচাতে থাকে যে, উল্লিখিত প্রাণী ও পাখিরা বুঝে ফেলে, এখানেই রয়েছে টুনটুনির বাসা। সাপ কানে শােনে না, কিন্তু টুনটুনির ওড়াউড়ি দেখে বুঝে ফেলে। অবশ্য টুনটুনির বাসা খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর ব্যাপার। পাতা মুড়ে কিংবা পাতা জুড়ে, সেলাই করে যে বাসা ওরা করে, সহজে কী আর নজরে পড়ে তা ? তবুও ডিম। বাসা নষ্ট হয়, নিজেকেও জীবন দিতে হয়। চুপচাপ থাকলে কার সাধ্য ছি; ওদের বাসা খুঁজে পায় !

বােকামির পরিচয় ওরা আরও বহুক্ষেত্রে দেয়। নিচু ঝােপঝাড়ে লাফায় ঝাপায়, চোখ রাখে না চারদিকে। ওঁৎ পেতে থেকে বেজি ও বনবিড়ালেরা অনেক সময় ধরে ফেলে ওদের। আনাড়ি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তা বেশি ঘটে।

পাশাপাশি সেবুদ্ধিমান পাখিও । বােকামি ও চালাকির এমন মিশ্রণ বাংলাদেশের খুব কম পাখির ভেতরেই দেখা যায়। বাসা যখন ওরা বাঁধতে শুরু করে, তখন খুব সতর্ক থাকে। উপকরণ মুখে করে আনার সময় সামান্য বাধাগ্রস্ত হলেই মুখ থেকে ফেলে দেবে উপকরণ। চলে যাবে অন্য দিকে। ডাকাডাকি করবে উত্তেজিতভাবে। তারপর চুপ হয়ে যাবে। ওরা চায় না, ওদের বাসাটা কেউ দেখুক, ওরা যে বাসা বাঁধছে, তা জানুক। ফেলে দেওয়া উপকরণ সুযােগ মতাে আবারও ওরা মুখে তুলে নেয়, বাসা সাজায়।

টুনটুনি বাসা করে মাটি থেকে অল্প উঁচুতে। আমি ১০ মিটারের বেশি উচ্চতায় কখনাে টুনটুনিকে বাসা বাঁধতে দেখি নি। বাসা বাঁধার জন্য ঝােপঝাড় বেশি পছন্দ ওদের, তবে বড় পাতাওয়ালা গাছই বেশি নির্বাচন করে ওরা। লাউ, শিম, শটি, কাঠবাদাম, সূর্যমুখী, ডুমুর, গুড়ি কচু, এলাচি, বাতাবিলেবুসহ চওড়া পাতাওয়ালা যে কোনাে গাছেই ওরা বাসা করতে পারে। স্ত্রী-পুরুষ মিলে আগে জায়গা নির্বাচন করে। তারপরে দু'জনে মিলেই পাতা টেনে মােড়কের মতাে করে। এ সময়ে যে কেউ একজন ঠোট দিয়ে ফুটো করে পাতা। অন্যজন মুখের লম্বাটে সুতাের মতন উপকরণ দিয়ে মােড়কটাকে সেলাই করে দেয়। একটি পাখিও পাতা মুড়ে একক প্রচেষ্টায় বাসার শুরুটা করতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু’জনই একসঙ্গে কাজ করে। প্রাথমিক সেলাইটা হয়ে গেলে দু’জনে খুশিতে ‘টুনটুন’ ডেকে ওঠে। এ হচ্ছে ওদের খুশির বহিঃ- প্রকাশ। তােমরা কিন্তু সহজে কেউ ওদের পাতা মােড়ানাের কৌশল, সেলাইয়ের নিপুণতা ও বাসা বাঁধার কাজটা দেখতে পারবে না। কেউ দেখছে বা কাছাকাছি আছে জানলেই ফুড়ুৎ। কেউ যদি দেখতেই চায়, ক্যামােফ্লেজ ব্যবহার করতে হবে। আমি মাত্র দু বারই খুব কাছে থেকে বাসা বাঁধতে দেখেছি। দু বারই আমি সুযােগ করে নিয়েছিলাম। প্রথম বাসাটি সম্পন্ন হয়েছিল ৪ দিনে। দ্বিতীয়টি অনিবার্য কারণে ৭ দিনে শেষ করেছিল ওরা। প্রথম ক্ষেত্রে ৪ দিনে ওরা ২৬২ বার বাসায় যাতায়াত করেছিল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যাতায়াত করেছিল ৪০৯ বার।

সরু উপকরণ দিয়ে ওরা যেভাবে গিট দেয়, তা না দেখলে অনুমানও করা যাবে না, কত বড় শিল্পী ওরা। বাসা বাঁধে খুব মমতায়। দু'জনে প্লান করে। মত বিনিময় করে। দুজন দুজনকে সাহায্য করে। স্ত্রী হয়তাে পাতার মােড়কের ভেতরে, পুরুষ বাইরে থেকে উপকরণ তুলে দিচ্ছে স্ত্রীর মুখে। বিপরীতও ঘটে। বাসা বাঁধার সময় ওরা না পারতে একটুও ডাকাডাকি করে না।

টুনটুনির বাসা হয় কিছুটা লম্বাটে ধরনের। তবে, পাতার মােড়কের মাপ অনুযায়ী বাসা ছােটবড় হয়। সাধারণ মাপ হচ্ছে ৮ ৫ সেমি.। আর বাসার উপকরণ হচ্ছে, পাটের আঁশ, চুল, ঝুল, মাকড়সার জাল, অত্যন্ত সরু শুকনাে লতা, ফেলে দেওয়া সুতাে, সরু শুকনাে ঘাস, তুলাে, কাপড়ের ছােট টুকরাে, উল, মুরগির ছােট পালক, গবাদি পশুর লেজের চুল ইত্যাদি। গদির জন্য সে কখনাে কখনাে কাশফুল, ঘাসফুল ব্যবহার করে। 

টুনটুনি হচ্ছে মুস্কিকাপিদি (Muscicapidae) গােষ্ঠীর সিলিভিনি (Sylviinae) উপগােষ্ঠীর পাখি। বৈজ্ঞানিক নাম অর্থটোমাস সুটোরিয়স (Orthotomus Sutorius)। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় Common Tailorbird। বিশ্বে নানান আকার ও নানান রঙের ওয়ালার রয়েছে। আমাদের দেশে যে পাঁশফুটকি রয়েছে, টুনটুনির সঙ্গে তার পার্থক্য নির্ণয় করা বেশ কঠিন। টুনটুনির জাতভাই। ওই পাঁশফুটকিকেও গ্রাম-গঞ্জে টুনটুনিই বলা হয়। রঙের পার্থক্য ছাড়া দু'টির। স্বভাব চরিত্র প্রায় অভিন্ন। বাসাও হয় প্রায় একই রকম। আকারে গড়নেও দু’টি প্রায় সমান সমান।

টুনটুনি গায়ক হিসাবে প্রথম শ্রেণীর নয়। গলার স্বর বেশ চড়া এবং কড়া। উত্তেজিত হলে যখন চেঁচায়, তখন তা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৫০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে। ওরা গান গায় বাসা বাঁধার আনন্দে, ডিম-বাচ্চা হবার খুশিতে। গানের ভাষা আর গালাগালের ভাষার ভেতরে পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। গলার স্বর হচ্ছে- “টিট টিট টুইট টিট টু-ই-ইট টিট টিট ....।” গান গাইবার সময়ে তাে বটেই, উত্তেজিত ডাকের সময় ওদের গলার দু পাশে কালাে রঙ জাগে। লেজ পিঠের ওপরে প্রায় খাড়া করে রাখে। ওই সূঁচালাে লেজের ডগা দোলে। লেজ দুই ভাগে বিভক্ত। অগ্রভাগ যেন সূচের মতন ধারালাে।

টুনটুনি দেখতেও সুন্দর নয়। ঠোট সােজা, সূচালাে। লম্বায় আধা সেমি.এর একটু বেশি। ওই ঠোট ফাঁক করে যখন সে কাউকে গালাগাল ঝাড়তে থাকে একনাগাড়ে, তখন ওর নীলচে জিভটা দেখা যেতে পারে। ঠোঁটের রঙ হাল্কা পােড়ামাটি। তবে নিচের ঠোটে সূক্ষ্ম গােলাপি আভা থাকে। ওর শরীরের মাপ হচ্ছে ১২ সেন্টিমিটারের একটু বেশি। লেজ শরীরের সমান। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। তবে চিবুকের রঙ দেখে স্ত্রী চেনা যায়। যখন বাসা হয়, তখন পুরুষের লেজের রঙ বেশ খােলে। কিছুটা বেড়েও যায়। ডিমবাসা হবার পর ওরা দারুণ টেনশনে ভােগে। তবুও গান গায়। ও সময় শব্দ হয়, “টিটি পিটি পিটি, প্রিইইটিই .... টিট।”

টুনটুনির বুক-পেট সাদাটে। ডানার উপরিভাগ লালচে। মাথা হালকা লালচে। চোখের মণি পাকা মরিচের মতন। গলা, চোখের দু’পাশ সাদাটে। কাছ থেকে পিঠ হলুদাভ, তাতে সবুজের মিহি মিশ্রণ। পা বাদামি। লম্বা লেজের রঙ পিঠের মতাে। দূর থেকে তাকে লাগে সাদাটে ও সবুজ পাখি।

বাসা সমাপ্ত হবার পরে দু'একদিন অপেক্ষা। তারপর ডিম পাড়ে। ডিম প্রায় ক্ষেত্রে হয় ৩টি। ২ এবং ৪ এর সংখ্যা কম। রঙ হালকা লালচে, তাতে থাকতে পারে বাদামি ছিট ও ছােপ। থাকতে পারে অতি সূক্ষ্ম নীলচে আভা। ডিম টিকটিকির ডিমের ৩/৪ গুণ বড়।

টুনটুনির খাদ্যতালিকায় আছে বিভিন্ন রকম অপকারী পােকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ছােট কেঁচো, মৌমাচি, রেশম মথ, ফুলের মধু ইত্যাদি। ধানপাট-আখের পাতার পােকা, শুয়ােপােকা ও তার ডিম, আমপাতার বিছা পােকাসহ বিভিন্ন ফসল ও ফলের অপকারী কীটপতঙ্গ খেয়ে ওরা মানুষ। এবং পরিবেশের দারুণ উপকার করে। পাশাপাশি কিছু উপকারী পােকামাকড়ও। খায়।প্রকৃতির জন্য এটাওপ্রয়ােজনীয়। টুনটুনি নিয়ন্ত্রণে রাখে ওই সব পােকামাকড়ের সংখ্যা। ফুলের পরাগায়নে টুনটুনির ভূমিকা রয়েছে।

এবার তােমরা টুনটুনি সম্বন্ধে একটি মজার তথ্য জেনে নাও। বাসা থেকে বাচ্চা যখন উড়ে বাইরে আসে, তখন টুনটুনিরা মজার কাণ্ড করে। বাসাকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে বাচ্চাদের নিয়ে চরাই করে। যত দিন যায়, বৃত্তের সীমা ততই বাড়ে। বাচ্চাদেরকে ওরা বাসার কেন্দ্রবিন্দু থেকে কখনাে দু’শ’ বর্গমিটারের বাইরে নেবে না। বাচ্চারা স্বাবলম্বী হলে বাবা-মা বাচ্চাদেরকে চেনাজানা এলাকায় রেখে অন্য কোথাও চলে যাবে। এদের বাচ্চারা দুষ্টুমি তেমন করে না। রাতে বাচ্চারা শরীরে শরীর মিশিয়ে বসে থাকে। টর্চের আলাে পড়লেও নড়ে না।

টুনটুনি ঢাকা শহরেও অনেক আছে। খুঁজলে তােমরা ওদের বাসাও পাবে। ইলেকট্রিক তারে বসেও চেঁচাতে থাকে। প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে আছে। ওরা নিরীহ পাখি। বর্তমান বাংলাদেশে ওরা ভালই আছে। সংখ্যায়ও প্রচুর।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url