বাংলাদেশের পাখি : সহেলি

বাংলাদেশের পাখি  সহেলি
এই যে অপূর্ব সুন্দর পাখি, এর নাম হচ্ছে সহেলি। সাতসয়ালি, লাল বুলবুল, লাল সাতসয়ালি, লাল পাখিও বলা হয় তাকে। ইংরেজি নাম হচ্ছে Scarlet Minivet. Tocato alla pericrocotus flammeus.


সুন্দরী গাছে সুন্দরী লতা, সুন্দর সুন্দর পাখিগুলাে সে লতায় বসে আছে। পাশাপাশি। সুন্দরবনে তখন বেশ হাওয়া, দুলছে সুন্দরী লতা, সুখদোলা খাচ্ছে পাখিগুলাে। পাশের খাল দিয়ে জল দৌড়াচ্ছে উপসাগরের দিকে। জলের গান আর বাতাসের তানে পাখিগুলাের চোখে ঘুমঘুম ভাব। ভােরবেলায় ওরা গান গেয়েছিল গলা ছেড়ে। তারপর বেরিয়ে পড়েছিল খাবার সন্ধানে। এখন প্রায় দুপুর। ওরা তাই বিশ্রাম নিচ্ছে।

সুন্দরী লতা তাে সুন্দরই, পাখিগুলাে আরও বেশি সুন্দর। মনে হচ্ছে লাল আর হলুদ ফুল ফুটে আছে সুন্দরী লতায়। প্রায় বিশটি পাখি। কিছু পাখির রঙ টুকটুকে লাল। অন্যগুলাের রঙ চকচকে হলুদ। ওরা যেন ইচ্ছে করেই পর পর বসেছে। অর্থাৎ একটি হলুদ পাখির পরে একটি লাল পাখি, তারপর আবারও হলুদ, তার পাশে লাল।

লাল যে পাখি, সে যে কী সুন্দর লাল ! সিঁদুর আর আলতা গুলিয়ে কোনাে শিল্পী যেন ওর বুকে মেখে দিয়েছে পরম সােহাগে। পেট এবং লেজের তলায়ও একই রঙ। কপাল, ঘাড় ও গলা কুচকুচে কালাে। চোখের মণি হালকা পাটকিলে। মণি ঘিরে হালকা সাদাটে বৃত্ত। বুজানাে অবস্থায় ডানার উপরিভাগ কালাে। মাঝখানের ৫/৬টি পালকের উপর চওড়া সিঁদুরের টান। ওর নিচে ডানার পালকের কিনারে লম্বালম্বি একই রঙের টান। পিঠের নিচের দিকটা আবার ওই সিঁদুর আলতা রঙ। লেজের উপরিভাগে যেন কালাে ফিতা সাঁটা, সে ফিতার মাঝ বরাবর শূন্য একটা সাদাটে সরলরেখা টানা। লম্বাটে লেজের গড়নটাও মনােমুগ্ধকর। পা কালাে। নিচের ঠোট কালাে, উপরের ঠোট আবছা সাদা। ঠোটে ধার আছে বেশ। উপরের ঠোঁট সামান্য আনুভূমিক বাঁকানাে। বুজানাে অবস্থায় ডানার ওপরে ধাতব একটা ভাব দেখা যায়, সামান্য সাদা ও লাল টানও চোখে পড়ে। যেহেতু ওরা গাছে গাছেই থাকে, তাই নিচ থেকে দেখে একে অপূর্ব লাল পাখি বলেই মনে হয়। এ হচ্ছে পুরুষ। মায়া ভরা চোখ তার।

আবার স্ত্রীকে দেখলে মনে হবে অলৌকিক এক হলুদ পাখি। কপাল, গলা, বুক, পেট ও লেজের তলা উজ্জ্বল হলুদ। লম্বা লেজের পালকের রঙও একই রকম হলুদ। ডানা বুজানাে অবস্থায় মাথার চঁাদি, ঘাড় ও পিঠ ধূসর ছাই। কী যে ঝকঝকে পালিশ করা পিঠ। এর লেজের উপরিভাগেও কালছে। রঙের চওড়া ফিতা সাঁটা, মাঝ বরাবর হালকা হলুদ সূক্ষ সরলরেখা টানা। ডানার ওপরে পাটকিলের বেষ্টনীতে কালাে কালাে ছােপ, পুরুষের যেমন রয়েছে। ৫/৬টি পালকের উপর চওড়া সিঁদুরের টান, এরও রয়েছে সেরকম টান, তবে রঙ হচ্ছে ওই চকচকে হলুদ। ঠোঁট কালাে। ঠোঁটের গড়ন পুরুষের মতােই। চোখের মণি হালকা পাটকিলে। চারপাশে হলুদ বৃত্ত। এ হচ্ছে স্ত্রী পাখি। ওদের উজ্জ্বল রঙ যেন চারপাশে দ্যুতি ছড়ায়। ওদের সৌন্দর্য দেখলে মুগ্ধ হতে হয়।

এই যে পাখি এরা বাংলাদেশের সুন্দর পাখিদের দলভুক্ত। গায়ক হিসাবেও ওরা প্রথম শ্রেণীর। স্ত্রী ও পুরুষের দৈর্ঘ্য হয় একই রকম, ১৯—২১ সেমি.। ওরা গভীর ও নিরিবিলি বন ভালবাসে। না পারতে মাটিতে নামে না। কিছুক্ষণ গান, কিছুক্ষণ খাওয়া আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম, এই হচ্ছে ওদের বৈশিষ্ট্য। তাই তাে সুন্দরী লতায় বসে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে এখন। সুন্দরবনে এদের। প্রচুর দেখা যায়। গ্রামীণ বনে দেখা যায় না বলতে গেলে। সিলেট-চট্টগ্রামের পাহাড়-টিলাময় জঙ্গলেও আছে।

একটু ওপাশেই গােলবন। গােলপাতার নিচে শুয়ে টানটান হয়ে ঘুমােচ্ছিল একটা বাঘ। সে উঠল। শরীরে প্রচণ্ড ঝাকুনি। পাখিগুলাে চোখ মেলে দেখল। শুধু, ভয় পেল না। বাঘকে ওদের ভালই মনে হয়, বানরেরা পালায় বাঘ দেখে, এই পাখিরা তাতে বােধ হয় খুশিই হয়। কেননা, খোঁজ পেলে বানরেরা এদের ডিম-বাচ্চা নষ্ট করে, বাসা ছিড়ে ফেলে। কেন এটা করে বানরেরা, তা এই পাখিদেরও জানা। এই পাখিরা বাঘ দেখে কোনাে সতর্ক সঙ্কেত দেয় না, অথচ বানর দেখলে দেয়। বানরের বন্ধু হরিণের ধারে-কাছেও এরা যায় না। যদিও পােকামাকড়, কীটপতঙ্গই এদের প্রধান খাদ্য। তাই বুঝি বানরের এত ক্ষোভ!

গােলবন থেকে বেরিয়ে এসে মস্ত সে বাঘ ডন-বৈঠক করে নিল। লালহলুদ পাখিগুলাে নির্বিকার। একটু ওপাশে গরানের ডালে ঝাকুনি দিয়ে উঠল দু’টি বানর, খক খক’ আওয়াজে পাখিগুলাে উড়ল, জঙ্গলের তলার ফঁাকায় দু’ চক্কর ঘুরল, তারপর পাক খেতে খেতে গাছপালার ফাঁক দিয়ে কী মনােরম ভঙ্গিতে যে শূন্যে উড়ে গেল ! শূন্যে অসংখ্য বৃত্ত এঁকে এঁকে ওরা সুন্দরবনের অনেক উপরে উঠে গেল, তারপর হঠাৎ-ই ঝরা পাতার মতন টুপটাপ নেমে | এল গেঁওয়া গাছের মাথায়। সাক খেতে খেতে ডালাপালার ফাঁক গলে এই যে উপরে ওঠা, আবার পাক খেতে খেতে নামা, তার ভেতরে রয়েছে এক শৈল্পিক ভঙ্গিমা। এত কাছাকাছি, এত ঘন হয়ে ওড়ে ওরা, অথচ কারও সঙ্গে কারও সংঘর্ষ হয় না। মনে হয় অনেকগুলাে লাল-হলুদ ফুল জড়াজড়ি করতে করতে ওপরে উঠে যাচ্ছে, নামছেও তেমনি।

এই যে অপূর্ব সুন্দর পাখি, এর নাম হচ্ছে সহেলি। সাতসয়ালি, লাল বুলবুল, লাল সাতসয়ালি, লাল পাখিও বলা হয় তাকে। ইংরেজি নাম হচ্ছে Scarlet Minivet. Tocato alla pericrocotus flammeus.

সুন্দরবনের যে সহেলির কথা বললাম আমি, ওদের যা স্বভাব, বিশ্বের অন্যান্য সহেলিরও স্বভাব প্রায় অভিন্ন। খাবারও। সবাই অবশ্য ভাল গায়ক নয়, তবে আমাদের সহেলি সুগায়ক। সে বাঘকে ভয় পায় না, হরিণকে ভয় | পায়, বানরকে দেখলে সর্তক সঙ্কেত দেয়। সে কুমিরকে ভয় পায় না, অজগর সাপ ও অন্যান্য সাপকে ভয় পায়। শিকারি পাখিদেরকে সে পাত্তাই দিতে চায় না। বনের ভেতরে ধাওয়া করে ধরতে যেমন পারবে না, তেমনি অত সহজে খুঁজে পাবে না বাসা। বাসাও বাঁধে বটে সহেলিরা! জায়গা নির্বাচন করে খুব দেখেশুনে। গাছের এমন ডালে বাসা করে যে, নিচের থেকে তা বােঝা যাবে না। দেখেও অনুমান করা কষ্ট, ওটা পাখির বাসা। যে ডালে বাসা বাঁধে উপকরণ আনে সেই রঙের। শুধু কি তাই? নরম কচুরিপানার শিকড়, পাতা, মাকড়সার জাল, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে বাসার চারপাশে ক্যামােফ্লেজ সৃষ্টি করে নিখুঁতভাবে। বাসাকে ওরা গােপন রাখতে জানে সুকৌশলে। বাচ্চারাও খিদের কান্না থামিয়ে রাখে, নড়াচড়া করে কম। বাসা বাধার জায়গা নির্বাচনে সময় লাগে ১-৩ দিন। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ১-৩ দিন। দু'জনে মিলে বাসা বানায়। তারপর কিছুদিন বিশ্রাম। অতঃপর ডিম পাড়ে। ডিম হয় অধিকাংশ সময় ২টি। কখনাে ৩, কখনাে বা ৪টি। সবগুলাে ডিম ফোটে। ডিমের রঙ গাঢ় ফিকে, হালকা সবুজাভ থাকে তাতে। হালকা বেগুনি ও হালকা বাদামি ছিট থাকে। ডিম বুলবুলের ডিমের সমান। একটু বেশি লম্বাটে। ডিম ফোটে ১৪–১৯ দিনে। বাচ্চারা উড়তে শেখে ১৫-২০ দিনে। বাচ্চারা যত বড় হয়, ততই রঙ ফোটে। শীত ও বর্ষা ছাড়া যে কোনাে মৌসুমেই বাসা বাঁধতে পারে ওরা। অন্য সময়ে দলবদ্ধভাবে থাকলেও বাসা বাঁধার সময় আলাদা হয়ে যায়। বাচ্চা উড়তে শিখলে আবার সবাই দলবদ্ধ হয়। তখন বাচ্চা ও বয়স্কদের পাশাপাশি দেখা যায়। বাচ্চারা মায়ের কাছে থাকতেই ভালবাসে। বাসায় থাকতে বাচ্চারা বেশি না কাঁদলেও উড়তে শেখার পরে কাঁদে। যারা মৌচাক কাটতে সুন্দরবনে যায়, এই পাখি। তাদের চোখে বেশি পড়ে। মৌচাক কাটতে গাছে চড়েও কেউ কেউ বাসা দেখতে। পায়। মৌচাকের ধারে কাছে বাসা বাঁধতেও এদের তেমন আপত্তি নেই। যদিও মৌমাছি এরা খায় না। খায় মৌমাছির ডিম-বাচ্চা। মানুষকেও এরা তেমন। ভয় পায় না। বাসা হয় ছােট, ছিমছাম। বাসার মুখের ব্যাস ১৬ সেমি, ও গভীরতা ৯ সেমি. হয়। শক্ত বুনট। সহজে টেনে হেঁড়া যায় না।

সহেলির গান খুব সুন্দর। অলৌকিক সুর ছড়ায় চারপাশে। ওরা ভােরে গান গায়, বিকালে গায়, সূর্য ডােবার আগেও গায়, ওড়াউড়ি করতে করতেও গায়। যখন বাসা বাঁধে, ডিম-বাচ্চা হয়, তখন ওদের কণ্ঠ বেয়ে যেন সুখ আর উচ্ছাস গড়িয়ে পড়ে। নিস্তব্দ জঙ্গলে ওই গান শুনলে যে কারও বুকই ভারী হয়ে উঠতে পারে। ওদের গানের ভাষা হচ্ছে—“হু হু ইউটি টিট টিট, গিইট – পিট সিট সিউটি - গিই-এ ....পিট....।” একটানা অনেকক্ষণ গান গায় ওরা। ওদের গানে আবার রয়েছে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বিশ্রামের সময়। যদি গান গায়, তখন শুরু হয় এক পাশ থেকে। একটি থামে পাশেরটি ধরে। এভাবে সবশেষ পাখিটি গান থামাবার পর আবার প্রথমটি শুরু করে। ভােরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা পাখিদের ভেতর এই প্রবণতা দেখা যায়। এই যে একপাশ থেকে শুরু হয়ে অন্যপাশে গিয়ে শেষ হওয়া, আবারও শুরু থেকে শুরু হওয়া, তা বাংলাদেশের আর কোনাে গায়ক পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। আবার অকারণে ঝাক বেঁধে ঘুরপাক খেতে খেতে আকাশে উড়তে ও নামতে সাধারণত অন্য পাখিদের দেখা যায় না। ওদের শরীরে রােদ পড়লে লাল আর হলুদ রঙ ঝলমল করে ওঠে।

আবার খাবার পাকড়াও করার সময় এদের ওড়ার যে ভঙ্গি, তাও বাংলাদেশের খুব কম পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়। উড়তে উড়তে এরা প্রয়ােজনে ক্ষণিকের জন্য হােভারিং করতে পারে, বাচ্চারা তা পারে নিখুঁতভাবে। উড়তে উড়তে এরা হাওয়ায় সাঁতার কাটার ভঙ্গিমায় শরীর যখন ভাসিয়ে রাখে, মনে। হয় বাতাসে শুকনাে পাতা। উড়ন্ত পােকামাকড় ধরতে যখন ধেয়ে যায় সাই করে, তখনাে দেখতে সুন্দর লাগে। আনাড়ি বাচ্চারা প্রায়ই উড়ন্ত পােকা মিস করে থাকে। মিস করার পরে কেঁদে কেঁদে ডাকে। বাচ্চারা যখন উড়ন্ত পােকাকে ধাওয়া করে, তখন লেজের পালক যায় খুলে। তখন পালক কয়টি আছে। গােনা যায়। লেজের পালক সব সময় ১০টি।

সুন্দরবনের বাইরে সহেলিকে দেখতে পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার। যদিও হাওয়া বদলের জন্য ওরা মাঝে-মধ্যে পাক খেতে খেতে অনেক ওপরে উঠে যায়, মনে হয় অনেকগুলাে লাল-হলুদ মৌমাছি যেন উড়ছে, তারপর পাক খেতে খেতেই সুন্দরবনের বাইরে এসে পড়ে, নেমে পড়ে আশেপাশের এলাকায়। দলছুট দু’-চারটে পাখিকে কখনাে কখনাে দূরের গ্রামেও দেখা যায়। কী জানি, দলপতি ওদেরকে নির্বাসনে পাঠায় কিনা ! বিচারে হয়তাে শাস্তি হয়, শাস্তি ভােগ করে। অন্যান্য দলবদ্ধ পাখিদের মতাে সহেলিদেরও একজন দলপতি থাকে।

সহেলি আছে চট্টগ্রাম, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে। ওরা বেশ লাজুক পাখি। লােকালয় বা খােলা জায়গায় ওরা আসেই না বলতে গেলে।। তবে আমি সুন্দরবনের বাইরে ওদের বাসা করতে দেখেছি।

বাংলাদেশে আরও ৩ রকমের সহেলি আছে। যদিও সংখ্যায় তারা কম। 

(১) ছােট সহেলি। 
(২) ছােট ঠোটওয়ালা সহেলি।
(৩) হলুদগলা সহেলি । 

এ ছাড়া সাদা পেট সহেলিও থাকতে পারে। ছােট সহেলি লােকালয়ে কখনাে কখনাে চোখে পড়ে। সংখ্যা কম। ছােট বেঁটে আর হলুদ গলা সহেলির আবাস পাহাড়ি জঙ্গল। তাই ওদের দেখা যেতে পারে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে।

সহেলিরা গাছের বন্ধু। ফুল-ফলের বন্ধু। প্রাকৃতিক বন তথা ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ওদের অবদান আছে। খুব সুন্দর পাখি। গানও সুন্দর। সুন্দর ওই গায়ক পাখিরা যাতে ভাল থাকে, সে চেষ্টা সবাকেই করতে হবে। তাছাড়া ওদের ওই পাক খেতে খেতে শূন্যে ওঠা, পাশাপাশি বসে বিশ্রাম করার মতাে চমৎকার সুন্দর দৃশ্যকে আমরা কি হারিয়ে যেতে দিতে পারি ? উৎসাহীরা ছােট সহেলি দেখতে চাইলে ঢাকার বাইরে সাভার বা গাজীপুরে যেতে পারেন। এরাও কম সুন্দর নয়। ছােট সহেলির ইংরেজি নাম Small Minivet. বৈজ্ঞানিক নাম Pericrocotus cinnamomeus.
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url