বাংলাদেশের পাখি : কালকূট
এই পাখিটির নাম কালক্ট। কালকুঁচও বলে। ইংরেজি নাম Common Coot। বৈজ্ঞানিক নাম Fuclica atra। শরীরের মাপ ৪০ সেন্টিমিটার। লেজ খুবই ছােট। কালকূট জলের পাখি। |
জনশূন্য হিন্দু গ্রামটির পশ্চিমে ছিল জোড়ার বিল'। পাশাপাশি দুটি লম্বাটে বিল। তাই এই নাম। ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছে দেশ জুড়ে। আগস্ট পর্যন্তও দু'চার ঘর হিন্দু গ্রামে ছিল। রাজাকারদের অত্যাচারে তারাও চলে গেল একদিন। গ্রামের গরু-ছাগলগুলাে রাজাকার আর লুটেরা বাহিনী নিয়ে গিয়েছিল মে মাসের মধ্যেই। বহু মােরগ-মুরগি ও তিতির পাখি রাজহাঁসসহ রয়ে গিয়েছিল গ্রামে। ছিল অনেক পাতিহাঁস। সবই ছিল পোষা ।
কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত টিকে ছিল খুব কম সংখ্যক। শিয়াল, খাটাস আর বনবিড়ালের কবলে পড়ার পরে বেঁচেবর্তে ছিল যেগুলাে, সেগুলাে বেশ চালাক-চতুর হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। পুরােপুরি বুনাে হয়ে গিয়েছিল । গ্রামে পুকুর-জলাশয়ের অভাব ছিল না। ছিল বনবাগান। খাদ্যসঙ্কট তাই ছিল না। পাতিহাসগুলাে সারাদিন থাকত জোড়ার বিলের জলে। রাতে থাকত বিলের মাঝে হােগলা বনের ভেতর।
সেই নভেম্বরে শীতের পাখি তথা পরিযায়ী পাখি বরাবরের মতাে এসেছিল ওই বিলে, ছিল দেশি জলের পাখি। সরালি, দিঘর, মুরহেন, চখাচখী, বালিহাঁস, মেটেহাঁস, জলপিপি, বড় হালতি, কালিম ও ডুবুরিসহ আরাে কত পাখি শিকারিরা আসে না বিলে। পাখিদের তাই যেন মেলা বসে গিয়েছিল সেবার ওই জোড়ার বিলে। পােষা হাঁসগুলােও ওদের সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। ওই বিলে সেবার বেশি দেখা গিয়েছিল কালাে রঙের একটি পাখিকে। কুচকুচে কালাে ওর ঘাড়-মাথা-গলা ও চিবুক। ঠোট চকচকে সাদা।
মজবুত মােটা ঠোট, শক্ত পাথরের মতাে। কপালে বর্ম, সেটাও ঠোটের মতাে সাদা ও মজবুত। মনে হয়, ওপরের ঠোটটা কপালে গিয়ে মিশেছে। ওই কপালের সাদার পাশে কুচকুচে কালাের ভেতরে কুঁচফলের মতাে চোখ দুটি দেখতে ভারি সুন্দর । পিঠের রঙ শ্লেটপাথরের মতাে কালচে, বুক-পেট ধূসর কালাে । কিন্তু ওরা থাকে হাঁসের মতাে জলে ভেসে।
তাই এক নজরে কালাে বলেই মনে হয়-মনে হয় সরালি হাঁসের চেয়েও বড়। সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে ওদের সাদা ঠোট ও কপাল। যখন ওড়ে তখন ডানার প্রান্তের সাদা পালক নজরে পড়ে। পা নীলচে। পায়ের লম্বা লম্বা আঙুলগুলাে নীলচে-বাদামি। নখগুলো ধারালো। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ওরা বেশ আরামেই ছিল। গােলাগুলি নেই। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে নানান প্রজাতির পাখিতে বিল একেবারে সরব হয়ে উঠল। এ রকম নির্ভয় পরিবেশ ওরা বহুকাল পায় নি ।
ডিসেম্বরের সেদিন ছিল ৭ তারিখ । একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে এসে। আশ্রয় নিয়েছিল জোড়ার বিলের পাশে। তারা যাবে ফকিরহাটের (বাগেরহাট) দিকে। ভােরে পাখির কলকাকলিতে তারা বিস্মিত। জোড়ার বিলের দিকে তাকিয়ে তারা পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা দেখে হতবাক। এত পাখি এল কোথেকে! ওদের মাঝে আবার পাতিহাঁসের ঝাকও দেখা যাচ্ছে! দু'একটা গুলি করলে প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়া যাবে। কমাণ্ডারের সিদ্ধান্তে একজন মুক্তিযােদ্ধা বন্দুকে কার্তুজ পুরে বেশ কাছ থেকে গুলি করল সরালির কঁাকে। সঙ্গে সঙ্গে বিলের সব পাখি বাতাসে ঝড় তুলে উড়াল দিল।
কিন্তু অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করল এই কুচকুচে কালাে পাখিগুলাে। ওরা ছিল এক জায়গায়, প্রায় একশটি পাখি। ওরা জলজ উদ্ভিদ-গুল্মের ওপর দিয়ে, শাপলা-পদ্ম পাতার ওপর দিয়ে দ্রুতবেগে দৌড়ে পাড়ি দিল প্রায় ৫০ গজ জায়গা। তারপর ঢুকে পড়ল হােগলাবনে। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে মনে হল, ওরা যেন দৌড় প্রতিযােগিতায় অংশ নিয়েছে।
গুলির শব্দটাই ছিল দৌড় শুরুর সঙ্কেত। ডানা মেলে ধরে লাফানাের ভঙ্গিতে ওরা যেন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নশিপে দৌড় দিয়েছে সবাই। সে এক চোখ জুড়ানাে দৃশ্য। শাপলাপদ্মপাতার ওপরে পা ফেলে যে ভঙ্গিতে ওরা দৌড়েছে, পা পড়েছে শরীরের আগে আগে, তাতে ওদের বলতে হয় দৌড়বিদ পাখি। জলের আর কোনাে পাখি সম্ভবত এমন চমৎকার ভঙ্গিতে দৌড়াতে পারবে না। পারবে না এদের সঙ্গে জিততে। এদের সঙ্গে দৌড় লাগিয়েছিল কালিমও। পারে নি। অথচ কালিমের চেয়ে কালাে এই পাখিরা ভারি ও মােটাসােটা ।
এই পাখিটির নাম কালক্ট। কালকুঁচও বলে, কালকূট জলের পাখি |
তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পাখি কুড়াতে নামল। ৯টি সরালি হাঁস পেল। পাতিহাঁসগুলাে দূরে সরে গিয়ে তখনাে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। একজন মুক্তিযােদ্ধা কালাে একটি পাখিকে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখে হাত বাড়াল, গুলির রেঞ্জে পড়ে আহত হয়েছে দারুণ। হাত বাড়িয়ে যেই না ধরেছে কালাে পাখিটিকে সঙ্গে সঙ্গে ওটি ডাক ছেড়ে কামড়ে ধরল মুক্তিযােদ্ধার ডান হাতের অনামিকা। যেন-বা ছােবল দিল। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার দিল মুক্তিযােদ্ধা, সরাতে চাইল হাত।
পারল না। শক্ত ঠোটে পাখিটি কষে চেপে ধরেছে একটি আঙুল। আঙুলটি অবশ, এই বুঝি দু'টুকরাে হয়ে যায়। অন্য দু'জন এগিয়ে এল। অনেক টানাটানি করেও তারা ছাড়াতে পারল না আঙুল, বরং আঙুলের চামড়া গেল খসে। তখন একজন মুক্তিযােদ্ধা গলা চেপে রেখে মেরে ফেলল পাখিটিকে। তারপর আঙুল মুক্ত হল। ঠোটের চাপে আঙুলের মাংস থেতলে গেছে। পাখিটি মরণ কামড় দিয়েছিল। গুলিতে সে আহত হয়েছিল দারুণ, তবু কামড় দিতে ভােলে নি।
কম আহত হলে জলের তলা দিয়ে ডুব দিয়ে চলে যেত অনেক দূরে। শুধু সাদা ঠোটসহ নাকটি জলের ওপরে জাগিয়ে রেখে শরীর রাখত জলের তলায়। বন্দুকের গুলিতে একখানা পা আহত বা ভেঙে গেলে ডুব দিয়ে জলের তলা দিয়ে এগােতে কষ্ট হয়। তখন উড়াল দেয়। ভালােই উড়তে পারে। ওড়ার সময় আহত বা ভাঙা পা খানার জন্য অসুবিধা হয় বলে ঝুলন্ত পা খানাকে ঠোটের ফাকে ধরে ওড়ে । সে এক দারুণ দৃশ্য।
সাদা ঠোট আর কালাে রঙের এই পাখিটির নাম কালকূট। কালকুঁচও বলে। ইংরেজি নাম Common Coot। বৈজ্ঞানিক নাম Fatica atra । শরীরের মাপ ৪০ সেন্টিমিটার। লেজ খুবই ছােট। কালকূট জলের পাখি। নিরিবিলি বিল-বিল, জলাশয় ও হাওর-বাওড়ই বেশি পছন্দ। দলবেঁধে থাকে, চরে বেড়ায়। অন্যান্য জলের পাখিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। ভালাে সাঁতার জানে। ডুব দিতেও ওস্তাদ। হাঁসের মতাে ডুব দিয়ে উল্টে গিয়ে জলের তলায় খাবারও খুঁজতে পারে, শুধু লেজটাই জেগে থাকে জলের ওপর। বেশ সাহসী, বুদ্ধিমান ও চালাক।
কালকূটের খাদ্য তালিকায় আছে জলের তলার উদ্ভিদ-গুল্মের কচি অংশ, ছােট ছােট মাছ, ব্যাঙ ও জলজ পােকামাকড়। ডাঙায় উঠেও এরা হাঁটতে পারে স্বচ্ছন্দে। সুযোগ পেলে ধানও খায়।
বাসা বাঁধার জন্য এরা পছন্দ করে বড়সড় হাওর-বাওড়ের বা মরা নদীর (যে নদীর ভেতরে জন্মেছে জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম শেওলা ও স্রোত নেই) জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম বা ঘাসবন। জলের পাশের ঝোপ-ঝাড়ের ওপরে বা মাটিতে বাসা করে। দু'জনে মিলেই বাসা সাজায়। ডিম পাড়ে ৯টি। বাফরঙা ডিম, তাতে বাদামি ছিটছােপ থাকে। ৭ ও ৮টি ডিমের সংখ্যাই বেশি। আবার ৫/৬টিও হয়। দু'জনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ২০/২২ দিনে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চারা উড়তে পারে ২৫-২৮ দিনে। তবে জন্মের ১/২ দিনের ভেতরই তারা বাসা থেকে জলে নেমে পড়ে এবং মা-বাবার পেছনে পেছনে ঘােরে ও ওদের পিঠে চড়ে সুযােগ পেলে। বাচ্চাগুলো খুব চঞ্চল।
বছরের অন্যান্য সময় কালকুটকে তেমন দেখা না গেলেও শীতকালে দেখা যায় প্রচুর। আমার মনে হয়, আশেপাশের দেশ থেকে আসা কালকূটদের সাথে আমাদের দেশের দু’পাঁচটা কালকূটেরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমার আরাে মনে হয়েছে খুব কম সংখ্যক কালক্ট আমাদের দেশে আছে বা থেকে যায়। ওরাই এদেশে ডিম-বাচ্চা তোলে।
একথা আমি জোরের সাথে বলতে চাইছি যে, কিশােরবেলায় কমপক্ষে আমি ৪ বার কালকুটের বাসা দেখেছি, একবার দেখেছিলাম ওই জোড়ার বিলে। ডিমে তা দেওয়া অবস্থায় একটি পাখিকে গুলি করে মারা হয়েছিল, ৭টি ডিম বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। ভাজতে গিয়ে দেখা গেল সব ক'টির ভেতরই রক্ত জমাট বেঁধেছে, খাওয়ার উপযােগী নেই। সেই জোড়ার বিল এখন মরে গেছে একেবারে।
আজ আর পাখি নামে না। নেই একটি জলপিপি বা ডুবুরিও। এভাবেই বিল-ঝিল-জলাশয়, হাওরবাওড় মরে যাচ্ছে আমাদের দেশে। পাশাপাশি বাড়ছে শিকারির সংখ্যা। জলের পাখিরা তাই আবাসভূমির পাশাপাশি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কোথাও শান্তি নেই। দু'দণ্ড সুস্থ হয়ে বসার জো নেই। বাসা বাঁধার জায়গার অভাবও প্রকট। পাশাপাশি খাদ্যসঙ্কট। দেশীয় জলের পাখিরা তাই চরম সংকটে আছে।
শীতকালে বাংলাদেশের বহু হাটবাজার ও শহর-বন্দরে দেশি-বিদেশি জলের পাখি বিক্রি হয়। আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এটা। সেই অপরাধই করছে অনেকে। আমাদের সবারই সচেতন হওয়া উচিত। সব ধরনের পাখিকে রক্ষা করা জরুরি। কেননা, পাখিরা শুধু প্রকৃতির উড়ন্ত দুরন্ত সুন্দরই নয়, নয় শুধু প্রকৃতির শােভা, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ওদের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। সুন্দর কালােপাখি কালকূটকেও শীতকালে হাটবাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। দেশের আইনে এটা নিষিদ্ধ। আইনের পক্ষে কি দাড়াতে পারি না আমরা সবাই?